ইসমাইল হোসেনঃ অতিমারি করোনায় বিধ্বস্ত বিশ্ব। মহাজাতির জীবনচিত্র যেন থমকে গেছে। বিশ্ব ক্যালেন্ডারে পরাজিত একটি দেশ ২০২০ সালকে সরকারি খাতা থেকে কেটে দিয়েছে। বিশ্বের ২১০টি রাষ্ট্রের মাঝে বাংলাদেশ একটি। আন্তর্জাতিক আবহে আক্রান্ত বাংলাদেশে পনের মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বিশ্ব মহামারি করোনায় বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের জীবন জীবিকা আজ হুমকির মুখে। সরকার জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে লকডাউন,কঠোর লকডাউন, বিধি-নিষেধ আকারে জারি করেছে। কখনো সামগ্রিকভাবে ও কখনো বিচ্ছিন্নভাবে বিধি-নিষেধ আরোপ থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সকল কর্মকান্ড অনেকটা স্বাভাবিকভাবে চলতে বলছে সরকার।
১৫ মাসে বিভিন্ন সেক্টর বন্ধ খোলার দোলাচলে থাকলেও একদিনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেনি। শতভাগ সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক বন্ধ রেখে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চলছে। চলমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখে দেখে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বিচ্ছিন্নভাবে চলার চেষ্টা করছে। সরকারি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান দুটি ভাগ হয়েে গেছে। সারাদেশে সরকারি সুবিধাবঞ্চিত চল্লিশ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে এক কোটির বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় দশ লক্ষ শিক্ষক নিয়োজিত আছেন। দেখা গেছে, চল্লিশ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মধ্যে অর্ধেকের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবান শিক্ষালয় হিসেবে কৌশলে পাঠদান করছে। বাকি অর্ধেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রুগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্যবান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক পক্ষ সরকারি বে-সরকারি,স্বায়ত্বশাসিত, আধা-স্বায়ত্বশাসিত,এম পিও ভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকায় সহজেই তারা পাঠদান করতে পারছে। এছাড়া স্বাস্থ্যবান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষ মৌসুমী ক্ষমতার প্রভাবে অতি সহজেই অনেকটা নিরাপদে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ফলে এসকল প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরণের ঝক্কিঝামেলা তেমন হচ্ছেনা। অপরদিকে রুগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষ শিক্ষিত বেকার শিক্ষক বা শিক্ষক কমিউনিটির হওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
উদাহরণ রয়েছে, রুগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা এসব প্রতিষ্ঠানের কোন কোন শিক্ষক একবেলা খাবারের জন্য গোপনে দুই/চারজন শিক্ষার্থীকে পড়াতে গিয়ে সরকারি বে-সরকারি জরিমানা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।জরিমানা দিতে ব্যার্থ হলে গ্রেফতার ও দন্ডভোগ করছেন। রুগ্ন শিক্ষকগুলো সরকারি দন্ড ছাড়াও কতিপয় সাংবাদিক ও বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
এমতাবস্থায় কেউ খাবে তো কেউ বাঁচবেনা, তা হবেনা মর্মে দুটি ভাগ দৃশ্যমান। পাশাপাশি কিছু শিশু পড়বে আর একই সময় কিছু শিশু দিন মজুরের কাজ করবে মর্মে বৈষম্য দৃশ্যমান। ফলে বর্তমানে স্বাস্থ্যবান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সক্ষম শিক্ষার্থীরা শিক্ষিত হওয়ার জন্য নিয়মিত লেখাপড়া করছে। আর রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের শিশুরা পড়ার টেবিল রেখে বিভিন্ন যানবাহনে শ্রমিকের কাজ করছে।
বাস্তবতা বলছে লেখাপড়া না থাকাই রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের শিশুরা প্রতিনিয়ত অপরাধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে সারাদেশে শিশু কিশোরদের নতুন নতুন গ্যাং তৈরি হচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১২.৩৫ মিনিটে গাজীপুর মহানগরের জয়দেবপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দেখা যায় রুগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিশু ঝুঁকিপূর্ণ বেটারিচালিত অটোরিকশা চালাচ্ছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তার সমবয়সী শিশু কিশোরদের ঝুঁকিপূর্ণ রিকশা অটোরিকশা ও গণপরিবহনে শ্রমিকের কাজ করতে দেখা যায়
জানা গেছে এই ধরনের শিশু কিশোর কলকারখানা ও বিভিন্ন ওয়ার্কশপে কাজ করার পাশাপাশি সন্ত্রাসী ও মাদক সিন্ডিকেটে ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আজ বেলা ১টার সময় সরেজমিন দেখা যায়, জয়দেবপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শিববাড়ি এলাকায় গাজীপুর এম ই এইচ আরিফ উচ্চ বিদ্যালয় এবং হাবিবুল্লাহ মেমোরিয়াল প্রাইমারি স্কুলে পাঠদান চলমান রয়েছে। স্কুলে গিয়ে দেখা যায় ক্লাস চলছে। ছাত্র ভর্তি চলমান আছে। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর এইচ এম আরিফ (বিসিএস শিক্ষা ) স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রায় একই নামের আরিফুজ্জামান খান জানালেন, স্কুলটির মালিক গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী এলাকায় অবস্থিত আরিফ কলেজের মালিক। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আব্দুল করিমের বাগানবড়ি হিসেবে পরিচিত ভবনটি ভাড়া নিয়ে স্কুলটি পরিচালিত করছেন। ক্লাস রুমে শিশুদের মাস্ক কেন নেই প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষক বলেন, যারা অনলাইনে পাঠদান করতে পারে না, তাদেরকে বিদ্যালয়ে ডেকে পাঠদান করানো হচ্ছে।
সাধারণ মানুষ বলছেন, বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই বৈষম্য আগত প্রজন্মকে মনস্তাত্ত্বিক সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পাশাপাশি সহপাঠীদের মধ্যে হিংসা হানাহানি ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবাপন্ন করে তুলছে।
এই অবস্থায় সাম্যের ভিত্তিতে আইন ও অধিকারের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষাখাতে বড়ধরনের বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হবে।