ঢাকা: দেশের সীমান্তবর্তী জেলাসহ আশপাশের জেলাগুলোয় করোনা ভাইরাসের রোগী বেড়েই চলছে। কোনো কোনো জেলায় করোনার সংক্রমণহার ৫০ শতাংশের বেশি। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টার কারণেই সংক্রমণ বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম। এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে সামনের দিনগুলোয় সংক্রমণ সারাদেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেশে বর্তমানে ৫০৯টি পরীক্ষাগারে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এসব ল্যাবে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৯৭০ জন। নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এটি সারাদেশের সংক্রমণের চিত্র হলেও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর সংক্রমণচিত্র ভিন্ন। কোনো কোনো জেলায় সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সাতক্ষীরা জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয় ৫০ জন। ২৪ ঘণ্টার নুমনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হার ৫৩ দশমিক ২০ শতাংশ। অথচ কিছুদিন আগেও এই জেলায় রোগী শনাক্তের হার ছিল মাত্র ২-৩ শতাংশ। গত রোজার ঈদের পর থেকে সাতক্ষীরা বা আশপাশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যান বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে ৯ হাজার ৫১টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪৫৪ জন। ঢাকা বিভাগে সংক্রমণহার ৫ দশমিক ০২ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৮২টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪৯ জন। ময়মনসিংহ বিভাগে সংক্রমণ হার ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ৮৫০টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৪৪ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে সংক্রমণহার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী বিভাগে ৩ হাজার ৩৪৪টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬০৭ জন। রাজশাহী বিভাগে সংক্রমণের হার ১৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগে ৪৪১টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৯৪ জন। রংপুরে সংক্রমণহার ২১ দশমিক ৩২ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৪০৮টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪২৭ জন। খুলনায় সংক্রমণহার ৩০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগে ২৭০টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪১ জন। বরিশালে সংক্রমণহার ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগে ৩২৩টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫৪ জন। সিলেটে সংক্রমণহার ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ।
জানা গেছে, ঈদের পর থেকে দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে সংক্রমণ বেশি বাড়ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে। আইইডিসিআরের তথ্য বলছে, এখন সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এদিকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়লে সেখানে আইসিইউ, সেন্ট্রাল লাইন অক্সিজেন সরবরাহ, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, আরটি-পিসিআর ল্যাব ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব রয়েছে। ফলে রোগী বাড়লে চিকিৎসাব্যবস্থা ব্যাহত হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, করোনা সংক্রমণ কতটা বিস্তৃত হবে, সেটি নির্ভর করবে কিছু কন্ডিশনের ওপর। যে এলাকাগুলো আক্রান্ত হয়েছে, সেখানে যদি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না যায়, তা হলে ব্যাপক সংক্রমণ হতে পারে। আমরা আগে বলতাম- গ্রামের লোকজন আক্রান্ত হয় না, এবার দেখা যাচ্ছে গ্রামের লোকজন আক্রান্ত হচ্ছে। এই ভ্যারিয়েন্টটি হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এই ভ্যারিয়েন্টে অনেক বেশি সংক্রমণ ছড়ায়। সুতরাং স্থানীয়ভাবে এর প্রভাব পড়বে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ম্যানেজমেন্টও এতো ভালো হবে না, ঢাকার মতো হবে না। অনেক জেলা আমরা জানি ছোট, যেখানে ভ্যান্টিলেটর সাপোর্টই নেই, সেক্ষেত্রে মানুষ চিকিৎসা নিয়েও সমস্যায় পড়বে- এটা হলো স্থানীয় প্রভাব। আর জাতীয় প্রভাব হলো- এই এলাকাগুলো থেকে সংক্রমণ সারাদেশে ছড়িয়ে যেতে পারে। কারণ অনেক জেলায় লকডাউন নেই, আন্তঃজেলা পরিবহন চলছে, গণপরিবহন চলছে। সুতরাং ইতোমধ্যে ওই এলাকায় ছড়িয়েছে। ওই জেলায়গুলো থেকে অন্য জেলায় কত মানুষ গেছে, তাদের মধ্যে কত মানুষ সংক্রমণ নিয়ে গেছে এবং যে এলাকায় যাচ্ছে সেখানে কত বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, সেটির ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের অবস্থা সামনে কী দাঁড়ায়।
তিনি আরও বলেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় সংক্রমণ বেশি, সেখানে কঠোর লকডাউন জোরদার করতে হবে। নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে, রোগী শনাক্ত এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং করে ব্যবস্থা নিতে হবে। সংক্রমণ প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা গেলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় চলতি জুন নিয়ে শঙ্কিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রবিবার দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে এই শঙ্কার কথা প্রকাশ করেন অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, গত মাসের মতো এটা স্বস্তির মাস না-ও হতে পারে।
অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, খুলনা, রাজশাহী, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ক্রমান্বয়ে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে আক্রান্তদের অধিকাংশই ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের শিকার বলে জানিয়েছে প্রশাসন। যে কারণে আমাদের একটি মেডিক্যাল টিম চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সব সীমান্ত এলাকার হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে জরুরি ছাড়া কোনো রোগী যেন ভর্তি না করা হয়- এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দরকার হলে সম্পূর্ণ হাসপাতাল করোনা বিশেষায়িত হাসপাতাল করে দেওয়া হবে। প্রান্তিক অন্য এলাকাগুলোতে তা-ই বলা হয়েছে।
অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, গত ৩০ মে থেকে সংক্রমণের হার উঠানামা করছে। এখন আমরা যে পর্যায়ে আছি, তাতে বলতে পারবো না যে, অবস্থা স্থিতিশীল। এখন পর্যন্ত আমাদের ট্রান্সমিশন আনস্টেবল। অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশি। আর সংক্রমণ অনেক বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হবে।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে; বিশেষ করে সীমান্তবর্তী (রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ, এবং খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট) এলাকায় সংক্রমণের উচ্চহার দেখা যাচ্ছে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করে কো-অর্ডিনেশন করা মুশকিল, যদি এসব এলাকায় অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হয়, তা হলে একটা সুরাহা হবে। তাতে দ্রুত রোগী শনাক্ত হবে, আর রোগী শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশন করা, রোগীর সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিন করতে সুবিধা হবে। আর যেসব এলাকায় আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেখানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হলে রোগী শনাক্তের হার আরও বাড়বে, আর তখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেও সুবিধা হবে।
রাজশাহী বিভাগে এক দিনে করোনা শনাক্তে রেকর্ড
রাজশাহী ব্যুরো : আমজাদ হোসেন শিমুল জানান, রাজশাহী বিভাগে বেড়েছে করোনা ভাইরাস শনাক্ত। গত রবিবার ও গতকাল সোমবার রেকর্ড সংখ্যক করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে কমেছে মৃত্যু। সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত দুজন মারা গেছেন।
মৃত্যু কমলেও গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগে করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে। পিসিআর ল্যাব, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ও জিন এক্সপার্ট মেশিনে মোট ৩ হাজার ৩৪৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ৬০৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে (শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ)। বিভাগের করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এক দিনে এটাই সর্বোচ্চ। আগের ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয় ৫০২ জনের। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় সহকারী পরিচালক নাজমা আক্তার স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নতুন ৬০৭ জন নিয়ে বিভাগে শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৪৩১। নতুন শনাক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রাজশাহী জেলার ২৭০ জন। এক দিনে জেলায় এটিই সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়েছে নওগাঁয় ১১৯ জন। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭৫ জন, নাটোরে ৩৫ জন, জয়পুরহাটে ৬১ জন, বগুড়ায় ১৬ জন, সিরাজগঞ্জে ১৫ জন ও পাবনায় ১৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় মোট ৩ হাজার ৩৪৪ জনের নমুনার মধ্যে ২ হাজার ২১৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পদ্ধতিতে। এতে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৭৭ জনের (১২ দশমিক ৫১ শতাংশ)। পিসিআর ল্যাবে ১ হাজার ৫৯ জনের নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৮৪ জনের (২৬ দশমিক ৮১ শতাংশ)। আর জিন-এক্সপার্ট মেশিনে মোট ৭১ জনের নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৪৬ জনের (৬৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ)।
২৪ ঘণ্টায় বিভাগে করোনায় মারা যাওয়া ২ জনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা। এ নিয়ে বিভাগে করোনায় মৃতের মোট সংখ্যা ৫৯৭। এর মধ্যে ৩১৮ জন বগুড়া জেলার আর ৯৩ জন রাজশাহীর। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫৬ জন, নওগাঁর ৪৫, নাটোরের ২৭, জয়পুরহাটের ১২, সিরাজগঞ্জের ২৪ ও পাবনার ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ৫ জুন বিভাগে মোট ১১ জন করোনা রোগী মারা যান। এ পর্যন্ত এটাই বিভাগে এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ রোগীর সংখ্যা কমেছে। আগের দিন ৪৩৯ জনের সুস্থ হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আজকের প্রতিবেদনে নতুন ১০৬ জন সুস্থ হয়েছেন বলে জানানো হয়। এ নিয়ে বিভাগে মোট সুস্থ হলেন ৩২ হাজার ৩৮৫ জন। বর্তমানে বিভাগের আট জেলায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪ হাজার ৫৫ জন। এর মধ্যে ৩৫ জন ভর্তি হয়েছেন গত ২৪ ঘণ্টায়।
দিনাজপুর জেলায় করোনা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় প্রতিরোধ কমিটির জরুরি সভা
দিনাজপুর থেকে রতন সিং জানান, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে জেলা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় ভার্চুয়ালি জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নুরুল ইসলাস পিএইচডি সংযুক্ত থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে দিকনির্দশনামূলক বক্তব্য রাখেন।
বৈঠকের বিষয়ে জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকির বলেন, এই জেলায় বর্তমানে কোভিড-১৯ সংক্রম ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়ায় সরকার তথা প্রশাসনের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। ফলে গত রবিবার বিকাল ৪টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বেঠকে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নুরুল ইসলাম।
হুইপ ইকবালুর রহিম জেলার করোনা পরিস্থিতির সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন ও সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল কুদ্দুসের বক্তব্য শোনেন। একই বক্তব্য শোনেন ধর্ম সচিবও। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী আগামী ৩ দিন জেলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রচারের চালানো হবে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগকে জেলার সর্বত্র গণসংযোগের মাধ্যমে করোনার ভয়াবহতার বিষয় অবগত করা এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচার ও সর্বত্র জনসমাবেশ না করতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত রবিবার রাতের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ (সোমবার) সকাল থেকেই জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার জেলা শহরে বের হয়ে হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশনসহ ব্যস্ততম এলাকায় অহেতুক জনসমাবেশ না ঘটানোর জন্য জনসাধারণকে পরামর্শ দিয়ে স্থান ত্যাগ করার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চালানো হয়।
এ ছাড়া দিনাজপুর শহরে ৫টি মোবাইল টিম এবং একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জনসাধারণকে মাস্ক ব্যবহারে সতর্ক করা হয়। এ সময় শহরেই ১৬০ জনকে মাস্ক ব্যবহারে অনিয়মের অভিযোগে জরিমানা করা হয়। জেলা প্রশাসক জানান, জেলার ১৩টি উপজেলাতেই এ ধরনের উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সমন্বয়ে গতকাল সোমবার সকাল থেকে শুরু করা হয়েছে।
নওগাঁয় লকডাউনের পঞ্চম দিনে বিধিনিষেধ মানার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের শিথিলতা
নওগাঁ থেকে আসাদুর রহমান জয় জানান, নওগাঁয় চলমান বিশেষ লক ডাউনের পঞ্চম দিন সোমবার সাধারণ মানুষের মধ্যে বিধিনিষেধ মানার ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখা গেছে। লকডাউন ঘোষিত এলাকা নওগাঁ পৌরসভা এবং নিয়ামতপুর উপজেলায় সাধারণ মানুষের অবাধ বিচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দোকানপাট বন্ধ থাকলেও পুলিশের প্রহরা এড়িয়ে বিভিন্ন সড়কে ছোট ছোট যানবাহন; বিশেষ করে রিকশা, ভটভটি, বেবিট্যাক্সি, অটো, সিএনজি, মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেখা গেছে। এসব সড়কে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষকে হেঁটে চলাচল করতেও দেখা গেছে। তবে প্রধান প্রধান সড়ক এবং এসবের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশের তদারকি অব্যাহত রয়েছে।
নওগাঁ পৌরসভা এলাকায় পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে ২৩টি ও নিয়ামতপুর উপজেলায় ১৮টি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করছেন। তার পরও মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না।
নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. এবিএম আবু হানিফ জানান, নওগাঁ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১১৯ ব্যক্তির শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ২ হাজার ৫০৪ জনে।
২৪ ঘণ্টায় নাটোরে করোনা সংক্রমণের হার ৪৯ শতাংশ
নাটোর প্রতিনিধি আল মামুন জানান, নাটোরে করোনার সংক্রামণের হার ৫২ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ কমে গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় আক্রান্ত হয়েছে ৪৯ শতাংশ। শহরে আক্রান্তের হার বেশি হওয়ায় শহরবাসীকে পরীক্ষায় উৎসাহিত করতে সোমবার থেকে বিনামূল্যে পরীক্ষার জন্য বিশেষ বুথ স্থাপন করেছে জেলা প্রশাসন।
নাটোরের সিভিল সার্জন ডাক্তার মিজানুর রহমান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় নাটোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪১ জনের অ্যান্টিজেন টেস্টের মধ্যমে পরীক্ষা করে ২৪ জন পজিটিভ হয়েছেন। এ ছাড়া রাজশাহীর পিসিআর ল্যাবে ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১১ জন পজিটিভ হয়েছেন।
নাটোর সদর হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. পরিতোষ কুমার বলেন, ৫ জন করোনা আক্রান্ত ছুটি পেলেও নতুন করে আরও ৭ জন ভর্তি হয়েছেন। এই হাসপাতালটিতে করোনার রোগীদের জন্য ৩১ বেড থাকলেও চিকিৎসাধীন ৩৯ জন। এ ছাড়া হাসপাতালটিতে আইসিইউ বেড না থাকায় জটিল রোগীদের পাঠানো হচ্ছে রাজশাহীতে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ বলেন, বর্তমানে জেলায় ৩৩৮ জন করোনা পজিটিভ রয়েছেন। এর মধ্যে শহরে সংক্রমণের হার বেশি। সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বগতির কারণে করোনা টেস্টে শহরবাসীকে উৎসাহিত করতে বিনামূল্যে টেস্টের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। কানাইখালী কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে নির্মিত বিশেষ বুথ থেকে শহরবাসীকে নমুনা প্রদানের আহ্বান জানান তিনি। বেশি বেশি টেস্ট করে শহরের আক্রান্তের প্রকৃত অবস্থা জানতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাগেরহাটে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধিতে ইউপি নির্বাচন স্থগিতের দাবি সচেতন মহলের
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, বাগেরহাটে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই ভারী হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। জেলায় সংক্রমণের হার ছাড়িয়েছে ৪৫ শতাংশের ওপরে। জেলার মোংলায় এই হার রয়েছে ৭০ শতাংশের ওপরে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক স্থগিত হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাগেরহাটের সচেতনমহল। অনেকেই মনে করেন বাগেরহাটে এই মুহূর্তে করোনার যে পরিস্থিতি, তাতে নির্বাচন দিলে আগামীতে আরও চরম ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. কেএম হুমায়ুন কবির বলেন, দশ দিন যাবৎ বাগেরহাটে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে মোংলা ও মোরেলগঞ্জে। সদরেও সংক্রমণের হার কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোংলায় ৭০ শতাংশ এবং জেলায় সংক্রমণের হার ৪৫ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ঘোষণা অনুয়ায়ী ২১ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটা যেহেতু স্থানীয় সরকারের নির্বাচন; সেখানে নির্বাচনী কাজে জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য মুভমেন্ট হবে, যার ফলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যাবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাড়ছে না লকডাউনের মেয়াদ
চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা সংক্রমণের কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্বার্থে সর্বাত্মক বিশেষ লকডাউনের মেয়াদ আর বাড়ছে না। তবে আগমীকাল থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত ৭ দিনের বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ এ ঘোষণা দেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশসাক জানান, ‘দোকানপাট ও শপিংমল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা যাবে; খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খাদ্য সরবরাহ ও বিক্রি করতে পারবে। সব ধরনের সাপ্তাহিক হাটবাজার বন্ধ থাকবে; জনসমাবেশ হয় এমন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে; আম পরিবহন ব্যতীত সব আন্তঃজেলা গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকবে, তবে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে অভ্যন্তরীণ গণপরিবহন চলাচল করতে পারবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে আম ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন চালু থাকবে। এ ছাড়াও জরুরি ও অত্যাবশকীয় পণ্য এবং সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিস, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।