কালিগঞ্জ (শ্যামনগর):সব ঘূর্ণিঝড়ের রাগ যেন আমাদের বাঁধের ওপর। বাঁধ ভাঙে আর আমাদের সব তলিয়ে যায়। প্রকৃতির নিয়মে পানি সরে গেলে আমাদের ঘরের পানি শুকায়। নিজেদের বাঁধ নিজেরাই বাঁধি সাধ্যমতো। গত ২০ বছর ধরে এভাবেই চলছে। বাঁধ চিকন হতে হতে কোথাও কোথাও আর দুই তিন ফুট আছে। আমাদের বাঁধে ২০ বছরে এক ঝুড়ি মাটিও দেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড। এখন আল্লাহ যা করে, তাই হবে। ক্ষোভ ও দুঃখভরা কণ্ঠে কথা বললেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের ইমান আলী।
শুধু ইমান আলী নন, এমন ক্ষোভ আর অভিযোগ এই উপকূলীয় এলাকার আরও অনেকের। গত ২ জুন ওই উপকূলীয় এলাকা ঘুরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের ক্ষোভ ও দুঃখের কারণ। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের শাহীন আলী জানালেন, চুনা নদীর বাঁধ ভেঙে তাদের এলাকার আজিজুল হকের বাড়ি থেকে ১৭ নং সøুুইস গেট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সমান হয়ে গেছে। এখন তার ওপর দিয়ে জোয়ার-ভাটা প্রবাহিত হয়। টাকা না থাকার অজুহাতে কাজ করে না কেউ। ফলে তাদের দুর্ভোগের কোনো সীমা নেই।
শ্যামনগরের গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জানান, তার ইউনিয়নের অনেক মানুষ এখনো পানিবন্দি। অনেকে এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এখানকার জমির দাম এখন লাখ টাকা বিঘা। টেকসই বাঁধ ছাড়া এখানে মানুষের বসবাস করা সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।
আশাশুনির আনুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর আলম লিটন বলেন, আমার ইউনিয়নের পাশ দিয়ে খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদ প্রবহমান। এই দুটি নদী তার ইউনিয়নের মধ্যে ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ বাঁধের কোনো মাটি নেই। আলমগীর বলেন, স্থানীয় অনেক নদী মরে গেছে। এলাকার লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে বাঁধ সংস্কার করতে হয় নিজেদের উদ্যোগে। ১০ বছরের চেয়ারম্যান জীবনের যত অর্জন তা সব ম্লান করে দেয় বাঁধ ভাঙনে।
আশাশুনির প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধই সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। ইয়াসের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে তার ইউনিয়নের ৬টি ওয়ার্ডে ১৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়। আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসীম বরণ চক্রবর্তী বলেন, ২০২০ সালে আমাদের উপকূলে ফনী, বুলবুল ও আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড় ক্ষত শেষ না হতে সম্প্রতি ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে আমাদের উপকূল আবারও ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। এই উপকূলকে বাঁচাতে হলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। সারাবছর উপকূলীয় বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজের তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। নদী ও খাল খনন ও নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে। বেড়িবাঁধ থেকে কমপক্ষে ২০০ মিটার দূরে চিংড়ি ঘের পরিচালনা করতে হবে। বেড়িবাঁধের দুপাশে লবণ সহিষ্ণু গাছ লাগাতে হবে। তিনি আরও জানান, কয়েক দফা ঘূর্ণিঝড়ের করাল গ্রাসে আশাশুনি সদর ইউনিয়নের জেলেখালী ও দয়ারঘাট গ্রাম দুটি এখন বিলুপ্তির পথে। ইতোমধ্যে প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া ও শ্রীপুর গ্রামের অন্তত শতাধিক পরিবার ও শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালী গ্রামের ২০টি পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়া খাজরা ইউনিয়নের খাজরা বাজার সংলগ্ন জেলে পাড়াও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। যে কোনো সময় প্লাবিত হয়ে গৃহহারা হতে পারেন তারা। এমন অবস্থা আশাশুনি ও শ্যামনগর উপকূলের অনেক এলাকার।
সাতক্ষীরায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগ রয়েছে। এই দুটি বিভাগের অধীন ৮০২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এগুলো ১১টি পোল্ডারে বিভক্ত। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর অধীনে দুটি পোল্ডার খুলনার কয়রা উপজেলার মধ্যে।
এমন দুর্যোগ নেই যে, উপকূলের কোনো না কোনো বাঁধ ভাঙেনি। আর বাঁধ ভাঙলেই জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে বাঁধ বাঁধার। কে কখন আসবে এজন্য কখনো তারা অপেক্ষা করে না। ইয়াসের ভাঙনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল ও ফণি, আম্পানসহ সব ঘূর্ণিঝড়েরই ক্ষত রয়েছে এসব এলাকায়। সর্বশেষ ইয়াসেও উপকূলের নদীভাঙন হয়েছে বেশি। এসব এলাকার অধিকাংশ স্থান এখনো তলিয়ে আছে।
এখনো প্রতিদিন হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণের কাজ করছেন। কিছু বাঁধ বেঁধেও ফেলেছেন।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড ১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের বলেন, তার বিভাগের অধীনে ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এগুলো চারটি পোল্ডারে বিভক্ত। তিনটি পোল্ডারের মধ্যে ১৫ কিলোমিটার বাঁধ বেশি ঝুঁকিতে।
বারবার বাঁধ ভাঙবে, আর মানুষ বাঁধ কোনো রকম ঠেকিয়ে রাখবে এমন ভাঙা গড়ার খেলা থেকে মানুষ কবে পরিত্রাণ পাবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উপকূলের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ১৫ নম্বর পোল্ডারের আওতাধীন গাবুরা ইউনিয়নের ২২ কিলোমিটার স্থায়ী বেড়িবাঁধের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রি-একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি টিম সরেজমিনে পরিদর্শনে আসবে। তারা প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে মতামত দিলে একনেকে সেটি অনুমোদন হবে। তারপর প্রকল্পটি পাশ হলে দ্রুত কাজ শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এছাড়া তার বিভাগের অধীনে শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ৫ নং পোল্ডারে আওতাধীন স্থায়ী বেড়ি বাঁধের জন্যও ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও পাঠানো হয়েছে। সেটিও দ্রুত পাস হওয়ার আশা করছেন তিনি এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুউচ্চ বেড়িবাঁধ কনক্রিটের সেøাব, পিস ব্যবহারের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় সুরক্ষা দেওয়া যাবে এসব ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসীকে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান জানান, সাতক্ষীরা পাউবোর বিভাগ-২ এর আওতাধীন কয়রা উপজেলার দুটি পোল্ডারসহ ৪২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৮২ কিলোমিটার ঝুঁকিতে ছিল। ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসে ২৫টি স্থানে বাঁধ ভেঙে যায়। ২৭ পয়েন্টে উপচে পড়ে। ইতোমধ্যে ১৮টি পয়েন্টের বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকিগুলো বাঁধার চেষ্টা চলছে। তিনি আরও জানান, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি পয়েন্টে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের একটি টিম এলাকায় পরিদর্শন করে মতামত দিলে কাজ শুরু হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ৩১ কিলোমিটার উপকূলকে সুরক্ষা দেওয়া যাবে বলে জানান তিনি। এছাড়া আশাশুনি উপজেলার জন্যও আলাদা একটি প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় সংসদ সদস্য সাতক্ষীরা-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলের নদীগুলির তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। এজন্য নদীর ড্রেজিং জরুরি। এখন কেবল বাঁধ দিলে হবে না। উঁচু টেকসই বাঁধের পাশাপাশি নদীর প্রবহমান ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণও জরুরি। এসব বেড়িবাঁধ সংস্কারে যেসব অর্থ বরাদ্দ হয় সেগুলোর সঠিকভাবে ব্যবহার হয় না বলেই এখানকার মানুষের দুর্দশা কমেনা বলে মন্তব্য করেন তিনি।