ঢাকা: সীমান্তবর্তী কিছু জেলায় করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি পাওয়া গেছে। জেলাগুলোর দৈনিক শনাক্তের হার স্পষ্ট করে দিচ্ছে, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের অতি সংক্রামক এ ধরনটির কমিউনিটি সংক্রমণ ঘটছে এবং দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর সীমান্তবর্তী আরও ৭ জেলায় লকডাউন দেওয়ার সুপারিশ করেছে সরকারের গঠিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, জেলাগুলো দিয়ে ভারতে মানুষের অবৈধ যাতায়াত সংক্রমণ বাড়ার মূল কারণ।
প্রথমদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ বাড়ার খবর এলেও এখন সীমান্তবর্তী অন্য জেলাগুলোয় সংক্রমণ বাড়তির দিকে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর খবর দিচ্ছে। পাশাপাশি সারা দেশে গত এক সপ্তাহে শনাক্ত হওয়া রোগী বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি।
আমাদের প্রতিনিধিরা স্থানীয় সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, করোনা শনাক্তের হার রাজশাহীতে ১৯ দশমিক ৬৩, সাতক্ষীরায় ৪১ দশমিক ১১, নাটোরে ৩৫, চাঁপাইনবাগঞ্জে ৬০ শতাংশের বেশি। জেলাগুলোয় ঈদের আগে শনাক্তের হার ছিল ১০ শতাংশের আশপাশে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোয়ও সংক্রমণ বাড়ার খবর পাওয়া গেছে। খুলনায় শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ বড় শহরগুলো থেকে লাখ লাখ মানুষ গ্রামেগঞ্জে যায়। সে সময় বাড়িমুখী মানুষ কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানেনি। তখনই শঙ্কা করা হয়েছিল, ঈদের পর সংক্রমণ বাড়তে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে সংক্রমণ বাড়ছে। অর্থাৎ ঈদের পর দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।
দেশে গত এক দিনে আরও ১ হাজার ৪৪৪ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন ৩৪ জন। নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী গতকাল শনাক্তের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। আগের দিন ছিল ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ।
ঈদের ছুটির আগেই দেশে করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছিল। এ ভারতীয় ধরন সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আশঙ্কা ছিল ঈদের ছুটির পর সংক্রমণ বাড়বে, বাস্তবে হচ্ছেও তা-ই। তবে সংক্রমণ বেশি বাড়ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয়। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। আরও ৭ জেলাকে লকডাউনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটি।
করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে শনিবার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে আলোচনার ভিত্তিতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। বিশেষজ্ঞ কমিটির এসব সুপারিশ চিঠি দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে।
বিশেষজ্ঞ কমিটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও আরও ৭টি জেলা নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও খুলনা জেলায় লকডাউন দেওয়ার সুপারিশ করেছে। লকডাউনের সময় বাস চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হয়। এ ছাড়া সেখানকার প্রান্তিক-দুস্থ মানুষদের সব ধরনের সাহায্য করতে বলা হয়েছে। এ সাহায্য দুভাবে করা যাবে- প্রথমত সরকারিভাবে ত্রাণ দেওয়া। দ্বিতীয়ত স্থানীয়ভাবে যারা দান করে থাকেন তাদের থেকে সম্পদ নিয়ে সাহায্য করা। লকডাউনের সঙ্গে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করতে হবে, না হলে লকডাউন কার্যকর হবে না।
গতকাল রবিবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ভার্চুয়াল বুলেটিনে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সংক্রমণ বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে বলেছেন, যেসব এলাকায় পাসপোর্ট নিয়ে ভারতে যাতায়াত হচ্ছে, তাদের খুব ভালোভাবে স্ক্রিনিংসহ কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে করোনা শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশনে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব এলাকায় বৈধ ছাড়াও অবৈধভাবে অনেকে ভারতে যাতায়াত করে। আমাদের চারদিকেই ভারত। তাদের সঙ্গে আমাদের যাতায়াত বা যোগাযোগ অনেকভাবেই বিদ্যমান। কিছু কিছু জায়গায় কেবল নৌকায় করেও যাতায়াত হয়। অবৈধভাবে যাতায়াতের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে।
অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, ইতোমধ্যে ঈদের সময় অনেকেই গ্রামে গিয়েছেন এবং তারা আবার ঢাকামুখী হয়েছেন। তাদের মাধ্যমেও এটা ছড়িয়ে যেতে পারে। এসব কারণেই সংক্রমণ বেড়েছে বলে মনে করছি।
বাংলাদেশে করোনার ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে। এ ধরন বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ইতোমধ্যে অন্তত ৪৪টি দেশে করোনা ভাইরাসের ধরনটি শনাক্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে চিহ্নিত করেছে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ (ভিওসি) হিসেবে। গত ৮ মে ভারত থেকে আসা তিনজন বাংলাদেশির দেহে করোনা ভাইরাসের এ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখন পর্যন্ত ২৩ জনের শরীরে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম শুক্রবার রাতে জানিয়েছিলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭ জনের শরীরে করোনার ভারতে শনাক্তকৃত ধরনটি পাওয়া গেছে, যারা কখনো প্রতিবেশী ওই দেশটিতে যাননি। এর মানে হলো বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের অতি সংক্রমিত ভ্যারিয়েন্টটি কমিউনিটি সংক্রমণ ঘটছে। প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন-
চাঁপাইনবাবগঞ্জে শনাক্তের হার ৬০ শতাংশের বেশি : শনাক্তের হার প্রতিদিনই প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি থাকছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় নতুন করে আরও ১০৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ৫৭ শতাংশ। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৫৩টি র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে ৫৩ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। যা নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার প্রায় ১২ শতাংশ। গতকাল রবিবার রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব তথ্য জানিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী।
গতকাল রবিবার লকডাউনের ৬ষ্ঠ দিনে সকাল থেকেই শহর ও শহরের বাইরের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে মানুষ ও যান চলাচলা নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ। তবে গতকাল রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল বেশি দেখা গেছে। এ ছাড়া জরুরি পণ্যবাহী যানবাহনের পাশাপাশি অটোরিকশা, সাইকেল, ভ্যান ও মোটরসাইকেলেও মানুষের চলাচল বেড়েছে। গত ১০ দিনে ভারত থেকে আটকা পড়া ৮৪ জন দেশে প্রবেশ করেছে সোনামসজিদ চেকপোস্ট দিয়ে। এদের মধ্যে দুজনের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
রাজশাহীতে এক মাসে করোনা শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৬৩ : ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা রাজশাহী জেলায় গত এক মাসে (১ মে-৩০ মে পর্যন্ত) ৪ হাজার ৫৪৩ জনের করোনার নমুনা পরীক্ষা করে ৮৯২ জনের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে রাজশাহীতে সংক্রমণের হার ওঠানামা করলেও ১ মাসে রাজশাহীতে শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
সাতক্ষীরায় সংক্রমণের হার ৪১ দশমিক ১১ শতাংশ : ২৪ ঘণ্টায় ৯০ জনের মধ্যে ৩৭ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৪১ দশমিক ১১ শতাংশ। ভারতের ধরনের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় জনগণ বেশি আতঙ্কিত। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ভারত ফেরত ৩৩৭ জনের মধ্যে ১৭ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে।
নাটোরে করোনার সংক্রমণ হার ৩৫ শতাংশ : জেলায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। গত ২ দিনে নাটোর জেলায় সংক্রমণ বেড়েছে। এ দু’দিনে ১৭১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬৮ জনের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। দুই দিনের সংক্রমণের হার প্রায় ৩৫ শতাংশ। সংক্রমিতদের অধিকাংশ নাটোর শহরের বাসিন্দা। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন মাঠে নেমেছে। নাটোর শহরে ৪টি চেক পোস্ট স্থাপন করে পাবলিক ও গণপরিবহনে তল্লসি করে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা হচ্ছে।