করোনাকালে ২৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা ঢাবিরই ১২ জন

Slider শিক্ষা


করোনা ভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এ সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে প্রায় ২৮ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ জনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি)। সবশেষ এ মিছিলে যুক্ত হন ঢাবির তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান। অবশ্য তিনি এলএসডি নামক এক ধরনের মাদক সেবনের পর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে নিজের গলায় দা দিয়ে কোপ দেন।

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ অনেক সময় ঠুনকো কারণেও আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যার মতো ভুল পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয় জেনেও মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর নানা কারণে মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে এই সময়ে সমাজে ধর্ষণ, আত্মহত্যার মতো অপরাধ বেশি ঘটছে।

দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদেরও অনেকের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউনে অধিকাংশ সময় বাড়িতে শুয়ে-বসে কর্মহীন কাটালে এ রকম সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এ থেকে রেহাই পেতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য চর্চা, সচেতনতার পাশাপাশি অহেতুক দুশ্চিন্তা না করা এবং পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করার পরামর্শ দেন তারা।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৮ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে ১২ জন। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর ঢাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম সিয়াম, ১৯ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেবজ্যোতি বসাক পার্থ, ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্রী জান্নাতুল হাসিন আত্মহত্যা করেন। ২৫ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করেন ঢাবির পুষ্টিবিজ্ঞানের সাবেক ছাত্রী রুমানা ইয়াসমিন। তিনি ৩৭তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে আনসার বাহিনীর সহকারী পরিচালক হিসেবে ট্রেনিংরত ছিলেন।

এ ছাড়া ঢাবির অনিন্দ ইশরাক, ইংরেজি বিভাগের ফারিহা তাবাসসুম রুম্পা ও চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইনের শুভজ্যোতি ম-ল, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক ছাত্র জাকারিয়া বিন হক শুভ ও কামরুল বাহার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ফাতেমা এলিন ফুজি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলহাস সিলভিয়া, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উলফাত আরা তিন্নি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আছিয়া আক্তার ও তোরাবি বিনতে হক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্দকার ফাকিহা নুর, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সুমন রায় সিধু, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের নীলম ধর অর্পা, বশেমুরবিপ্রবির সাদিয়া কুতুব ও মনীষা হিরা, ড্যাফোডিলের রবীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুর রহিম, বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রেমিকযুগল সুপ্রিয়া দাস ও তপু মজুমদার, ঢাবির তরুণ সেন ও সুমাইয়া খাতুন আত্মহত্যা করেন।

ঢাবির অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, বিভিন্ন কারণে মানুষ বিষণœতায় ভোগে। কতগুলো কারণ একত্রিত হলে বিষণœতার লেভেল চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সমাজে শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। এ সমস্যা কারও একার পক্ষে দূর করা সম্ভব নয়। আমাদের আরও সহানুভূতিশীল হতে হবে, তারপর বিষয়গুলো কমে আসবে।

সমাজবিজ্ঞানী ড. নেহাল করিম বলেন, করোনাকালে সব বয়সী মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদকাসক্তি, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতাসহ নানা কারণে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। তরুণ প্রজন্মের কাছে ক্যারিয়ার বড় একটা সমস্যা। তারা কখন পড়াশোনা শেষ করবে, কখন চাকরিতে যাবে- এ নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। অনেকে টিউশনি করে চলে। তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে সবাই সামাজিকভাবে অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা শঙ্কিত থাকে। অন্য সময় তো বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকরা থাকেন, তাদের থেকে কাউন্সেলিং নিতে পারে; কিন্তু এ সময়ে সবাই সবার নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। করোনায় সারা বিশ্বেই আত্মহত্যা বেড়েছে। কারণ সোশ্যাল সিস্টেমটা স্বাভাবিকভাবে এই মুহূর্তে কাজ করছে না। করোনার কারণে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক সবকিছুতেই প্রচ- একটা চাপ তৈরি হয়েছে- সেটা একটা বিশাল কারণ।

ঢাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগের অনারারি অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম বলেন, একজন মানুষ যখন মানসিকভাবে আঘাত পায় বা ব্যর্থ হয় তখন তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পরিবার-বন্ধুদের সহমর্মিতার প্রয়োজন।

অধ্যাপক মেহজাবীন বলেন, আত্মহত্যা রোধে পরিবার-সহপাঠীরা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। একজন ব্যক্তি হঠাৎ করেই প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত নেয় না। এর আগে ‘কিছুই ভাল্লাগে না’ জাতীয় কিছু আলামত দেখা যায়। এমন অবস্থায় পরিবার-সহপাঠীদের উচিত তার ভেতরের বিষয়টি জানার চেষ্টা করা, পাশে দাঁড়ানো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *