১২ই মে’র ঘটনা। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান ভারতফেরত করোনা পজেটিভ হওয়া রোগী সিলেটের আসমা বেগম। কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে আসমার সঙ্গে ভারতফেরা যুবকেরও করোনা পজেটিভ হয়েছিল। ফলে সিলেটে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের তরফ থেকে তাৎক্ষণিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নমুনা সংগ্রহ করে সিক্যুয়েন্স পরীক্ষার পর মারা যাওয়া মহিলা কিংবা সঙ্গে থাকা পুরুষের শরীরে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সিলেটের তিন দিকেই ভারত। আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা।
ফলে সিলেটে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন- সতর্ক না থাকলেও যেকোনো সময় সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতে পারে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। এ কারণে সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার এলাকায় অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কেবলমাত্র বিয়ানীবাজারের শ্যাওলা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি ছাড়া সবকিছুই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তামাবিল, ভোলাগঞ্জ, জকিগঞ্জ স্থলবন্দর দিয়ে যাত্রী আসা-যাওয়া বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের তরফ থেকে জানানো হয়েছে- করোনার দ্বিতীয় ওয়েবে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঈদ শপিং ও বাড়ি যাওয়া-আসার কারণে এমনটি হয়েছে। তবে সীমান্তবর্তী ৬টি উপজেলায় করোনা পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি সিলেট শহর ও আশপাশ এলাকার। সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মোজয় দত্ত মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ভারতফেরত এক মহিলা করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর ও সঙ্গে ভারত সফর করা পুরুষের করোনা পজেটিভ আসার পর সিলেটে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে শঙ্কা ছিল। পরবর্তীতে নমুনা সিক্যুয়েন্স রিপোর্টে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি জানান, গত ১৫ দিনে সিলেটের সীমান্ত এলাকার পোর্ট দিয়ে ভারত থেকে কোনো যাত্রী আসেনি। এই সময়ের মধ্যে সিলেটে ২৬ জন যাত্রী বেনাপোল ও বুড়িমারী সীমান্ত দিয়ে সিলেটে এসেছেন। তাদের আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন শেষে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। এদিকে যাত্রী না এলেও শঙ্কা যে কাটছে না তা নয়। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যাতে সিলেট সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শে সিলেটে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেটের সীমান্তবর্তী বিয়ানীবাজার উপজেলা। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়েব মিলে এই উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা ৫৪৮ জন। আবার এই উপজেলার শ্যাওলা স্থলবন্দরে এখনো পণ্য আমদানি-রপ্তানি চলছে। এক্ষেত্রে বিয়ানীবাজার উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন খান জানিয়েছেন- গত এপ্রিলে ৩০ ও মে মাসে ৪৬ জন করোনা পজেটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এটি সীমান্ত এলাকার কারণে যে হচ্ছে তা নয়। স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে এমনটি হয়েছে বলে জানান। তিনি জানান, শ্যাওলা স্থলবন্দর দিয়ে গত ১৫ দিন ধরে যাত্রী আসা-যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। পণ্য আমদানি-রপ্তানি হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করা হচ্ছে। ১৫ দিন ধরে সিলেটের গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ স্থল বন্দর দিয়ে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জে এখন পর্যন্ত ৪৫ জন রোগী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. কামরুজ্জামান রাসেল। তিনি জানান, সীমান্ত এলাকায় কড়া নজরদারি ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়েছে। গোয়াইনঘাটের তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে এখন কেউ আর দেশে প্রবেশ করছেন না বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রেহান উদ্দিন। তিনি জানিয়েছেন, পোর্ট বন্ধ হওয়ার আগে কয়েক জন ভারতফেরত যাত্রী তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে গোয়াইনঘাটে এসেছেন। তাদের কোয়ারেন্টিন-পর্ব শেষ করে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে গোয়াইনঘাট সীমান্ত এলাকা প্রশাসনের তরফ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। গোয়াইনঘাটে এখন পর্যন্ত ১২৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। একই অবস্থা সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জেও। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আব্দুল্লাহ আল মেহেদী জানিয়েছেন, তার উপজেলায় প্রায় আড়াইশ’ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে এটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েনি। ভারতের সঙ্গে নদীকেন্দ্রিক বর্ডার থাকায় এখনো অবাধ যাতায়াত নেই। বলেন- জকিগঞ্জ স্থলবন্দর দিয়ে কোনো যাত্রী আসছেন না। সপ্তাহে একদিন সাতকড়া আসে। তাও দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়ে আসা হয়। সিলেটের সীমান্ত এলাকায় দৃশ্যের বাইরে অদৃশ্য বিষয় হচ্ছে চোরাচালান। সীমান্ত এলাকার সিন্ডিকেটরা করোনাকালে চোরাচালানে সম্পৃক্ত ছিল। এ নিয়ে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা ছিল সীমান্ত এলাকায়। কিন্তু গত এক মাস ধরে চোরাচালানও হচ্ছে না। করোনার কারণে প্রশাসনের ব্যাপক নজরদারির কারণে চোরাচালানি সিন্ডিকেটও পিছু হটেছে। সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. লুৎফর রহমান মানবজমিনকে জানিয়েছেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থেকে সতর্ক থাকতে সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। একই সঙ্গে অবৈধ যাতায়াত ও অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে সীমান্তবাসীকে বিরত রাখতে নজরদারি করা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি’র পক্ষ থেকে সবচেয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে। টহল বাড়ানো হয়েছে সীমান্তে। ৪৮ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল আহমদ ইউসূফ জামিল জানিয়েছেন, করোনার কারণে সীমান্ত এলাকায় অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। বিজিবি’র পক্ষ থেকে তাদেরকে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি করোনা সতর্কতা নিয়ে বিজিবি’র পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চলছে।