ভালোবাসার আর্তচিৎকার ও বিভৎস মানবতা!

Slider নারী ও শিশু বাংলার মুখোমুখি


গাজীপুর: একজন নেতার যখন জনপ্রিয়তা থাকে তখন ভক্তকুলের ভীড়ে বেসামাল অবস্থা। নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত ঠিক-ঠিকানা থাকে না। দলে অবস্থান আর টাকা থাকলে নেতার জনপ্রিয়তা হাতে ছুঁয়ে দেখারও বাইরে থাকে। কিন্তু নেতার যখন খারাপ সময় আসে তখন আর ভক্তরা তেমনভাবে কাছে আসে না। ভালো সময়ে ভীড় ও মন্দ সময়ে এড়িয়ে যাওয়া ভক্তের সংখ্যাই দিন দিন বাড়ছে। আর নেতা যদি মারা যায়, তবে তো আর নেতার বাসায় মাছিও আসতে চায় না। কারণ মধু না থাকলে মাছি আসবে কেন। মধুটা যে শুধু টাকা তাই নয়, ক্ষমতা ও প্রভাব মিলেই মধু তৈরী হয়। এটাই দেশের সবশেষ রাজনৈতিক থাকা না থাকার ফসল।

নেতার জীবদ্দশায় যেখানে বছরের বিশেষ দিনগুলোকে ঘিরে নানা শ্রেনী পেশার মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠত বাড়ির বৈঠকখানা, নেতার অবর্তমানে সেই সকল লোকেরা ফিরেও তাকায় না। বরং নেতার জীবদ্দশায় সুবিধাবাদী চক্র নেতার মৃত্যুর পর নেতার স্থান সম্পদ ও জনপ্রিয়তা লুট করার জন্য মরিয়ে হয়ে উঠে। বর্তমান সময়ে এই সব কথা স্মৃতি নয় বাস্তব বটে।

গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শহিদুল্লাহ শহীদ। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচনও করেছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ধানের শীষের মেয়র প্রার্খী ছিলেন। মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শহীদের ভাই ধানের শীষ না পেয়ে স্বতন্ত্র মেয়র পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। শহীদের মৃত্যুর পর তার জানাজায় স্বরণকালের সেরা জমায়েত হয় মাওনা এলাকায়। দলমত নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের উপস্থিতি রাজনৈতিক সমীকরণকেও সহজ করে দেয়। শহীদের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শ্রীপুর এলাকার অধিকাংশ আইডিতে শোক প্র্রকাশ করে মরহুম শহীদের প্রতি লাখো মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু শহীদের মৃত্যুর পর তার তিন এতমি সন্তান ও স্ত্রীর খবর পর্যন্ত নেয়নি কেউ।

শহীদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শহীদ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকেই শহীদের স্ত্রী ও সন্তানদের কোনঠাসা করে রাখা হয়। শহীদের মৃত্যুর পর হঠাৎ করে শহীদের পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। শহীদের ভাইয়েরা শহীদের মৃত্যুর পর শহীদের সম্পদ থেকে তার স্ত্রী ও সন্তানদের উচ্ছেদ করার জন্য অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করে। এক পর্যায়ে তালা বন্ধ করে রাখলে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে কোনমতে জরুরুী কয়েকটি তালা খুলে দেয়। শহীদের স্ত্রীর ভাষ্যমতে, বাচ্চাদের জন্য খাবার আনতেও বাসার বাইরে কাউকে পাঠানো যায় না নির্ভয়ে। চুরি চুরি অবস্থায় শিশুদের জরুরী খাবার আনতে হচ্ছে। শহীদের মার্কেট দোকান ও টাওয়ারের তেমন কোন টাকা তাকে দেয়া হচ্ছে না। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি দোকানের ভাড়া এনে কোন মতে মানবেতর জীবন যাপন করছে শহীদের পরিবার। নিয়মিত ভয়ভীতি ও হুমকির মধ্যে তিন শিশু সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন এক সময়ে জনপ্রিয়তা নেতা মরহুম শহীদুল্লাহর স্ত্রী।

এ বিষয়ে শ্রীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়রী নিয়ে গেলেও পুলিশ শহীদুল্লাহর স্ত্রীর ডায়েরী গ্রহন করেনি। মিডিয়ায় এ বিষয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশের পর শ্রীপুর থানার ওসি শহীদুল্লাহর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আপোষ হয়েছে কি না জানতে চেয়েছেন। ওসি আসার পর শহীদুল্লাহর ভাই শাহ আলম গং অুনরোধ করে শহীদুল্লাহর স্ত্রী সন্তানদের সাথে খাওয়া দাওয়া করে কৌশলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়। কথিত আপোষ প্রমানের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই অপপ্রচার বলে জানায় শহীদুল্লাহর স্ত্রী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌর এলাকার মাওনা ওভারব্রীজের পশ্চিম পাশে সদ্য প্রয়াত মেয়র প্রার্থী শহিদুল্লাহ শহিদের পরিবার নিরাপত্তা আতঙ্কে পড়ে যায়। শহিদের ভাইয়েরা মরহুম শহিদুল্লাহর সম্পত্তি দখল করে তিন এতিম শিশু সন্তান ও শহিদুল্লাহর স্ত্রীকে নিজ বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখেন বলে শহিদুল্লাহর স্ত্রীর অভিযোগ। গত ২৬ জানুয়ারী এই ঘটনা ঘটে।

পারিবারিকভাবে মুক্ত হতে না পেরে শহিদুল্লাহ স্ত্রী তার স্বাক্ষরিত একটি সাধারণ ডায়েরীর আবেদন শ্রীপুর মডেল থানায় পাঠিয়ে নিরাপত্তা চান। থানায় ওসি না থাকায় পরিদর্শক তদন্ত তাৎক্ষনিকভাবে একজন এসআইকে( এস আই সুমন) ঘটনাস্থলে পাঠান। এসআই ঘটনাস্থলে গিয়ে জিডির সততা পান বলে গণমাধ্যমকে জানান। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সুমন ঘটনাস্থলে থাকা অবস্থায় একটি ফোন আসলে সুমন বের হয়ে যান। ফলে অবরুদ্ধ পরিবারকে মুক্ত করতে পারেনি দারোগা সুমন। ঘটনাস্থল থেকে বোরিয়ে সুমন বাদীপক্ষকে ওসির সাথে কথা বলতে বলেন। গভীর রাত হওয়ায় শহুিদ্ল্লুাহর শশুর শেখ আব্দুর রাজ্জাক পরদিন বিকেলে ওসির কাছে গেলে ওসি প্রতিপক্ষ এসেছিল বলে রাজ্জাককে জানিয়ে ঘটনা আপোষ করে দিবেন বলে জানান।

এদিকে বিষয়টি গণমাধ্যমে ফলাওভাবে প্রচারিত হলে এসআই সুমন দ্বিতীয়বারের মত ঘটনাস্থলে যায় এবং ৭ টির মধ্যে একটি তালা খুলে দেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারী দুপুরে ওসির পরামর্শে পারিবারিকভাবে বসে বিষয়টি নিস্পত্তি করার খসড়া তৈরী হয়। ওই দিনই সন্ধ্যায় ওসি সিভিল পোষাকে ভিকটিমের সাথে দেখা করে আপোষের বিষয় সম্পর্কে জানতে চান। পরদিন প্রতিপক্ষ একটি আপোষনামা তৈরী করে ভিকটিমের স্বাক্ষর নিতে যায়। স্বামীর সম্পদ ও তার পরিবারের নিরাপত্তার লিখিত নিশ্চয়তা না পেয়ে ভিকটিম আপোষ নামায় স্বক্ষর করেননি। আর প্রতিপক্ষ নানা কৌশলে আপোষ নামায় ভিকটিমের স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করছেন। ঘটনার খবর পেয়ে স্থানীয় সাংসদ ইকবাল হোসেন সবুজ ভিকটিমের সাথে কথা বলে ১১ফেব্রুয়ারী বসে সমস্যা সমাধান করে দিবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্ত অদ্যবধি পর্যন্ত বিষয়টির কোন ফয়সালা হয়নি।

শ্রীপুর থানার একটি গোপন সূত্র জানায়, কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত শ্রীপুর পৌর নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী হিসাবে শাহ আলম নির্বাচন করেন। নির্বাচনের দিন ভ্রাম্যমান আদালতের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগের ঘটনায় শাহ আলম থানায় আটক হয়। পুলিশ কিছুক্ষন পর তাকে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে শাহ আলমের সাথে ওসির একটি ব্যাক্তিগত সখ্যতা গড়ে উঠে। কিন্তু পরবর্তি সময় শাহ আলমের বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, একজন নাগরিক নিরাপত্তা চেয়ে জিডি নিয়ে গেলে পুলিশ জিডি নিতে বাধ্য। কিন্তু জিডি, অভিযোগ বা মামলা কিছুই না নিয়ে নিরাপত্তা অনিশ্চিত করে আপোষের জন্য চাপ তৈরী করা একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাজ নয়। এছাড়াও প্রতিপক্ষ বিএনপির লোক থাকায় রাজনৈতিক ঝামেলাও ছিল না। তাহলে কেন ওসি সাহেব এমনটি করলেন তা বোধগম্য নয়। তবে একজন ওসির ব্যর্থতার দায় পুরো রাষ্ট্র বহন করবে এমনটি নেই। রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ বাধ্য। কোন কর্মকর্তা অবহেলা করে থাকলে তার দায় নিজের,রাষ্ট্রের নয়।

প্রসঙ্গত: গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌরসভার প্রয়াত মেয়র প্রার্থী শহিদুল্লাহ শহিদের স্ত্রী তিন সন্তান সহ ৯দিন ধরে নিজ বাসায় অবরুদ্ধ থাকেন। ৮ম দিনে অরুদ্ধ থাকা অবস্থায় বাসার গেট ভেঙ্গে একটি কক্ষ তছনছ করা হয়েছে। এই বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়ায় এতিম পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন প্রয়াত শহীদের স্ত্রী। ৩ ফেব্রুয়ারী ভিকটিম জানান,প্রতিপক্ষ শাহ আলম লোকজন নিয়ে তার বাসায় যাতায়াতের একমাত্র পকেট গেট ভেঙ্গে নিয়ে গেছেন। এ সময় তারা শহিদের বাসায় প্রবেশ করে একটি রুম থেকেও জিনিসপত্র নিয়ে যায়। খবর পেয়ে এস আই সুমন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বাসাটি মুক্ত করতে পারেনি।

শহীদের স্ত্রী সুইটি জানান, তার স্বামী শহিদুল্লাহ শহিদ শ্রীপুর পৌরসভায় মেয়র পদে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে দুইবার নির্বাচন করলেও শেষবার নির্বাচনের মাঝপথে মারা যান। এতে নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর পুনরায়র তপসিল হয়ে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এই নির্বাচনে শহীদের ভাই শাহ আলম ধানের শীষের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে পরাজিত হন। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৫দিন মৃত্যুও সঙ্গে যুদ্ধ করে তার স্বামী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান। সুইটির ভাষ্যমতে, তার স্বামীর যাবতীয় চিকিৎসা স্বামীর ভাই শাহ আলম, মোস্তফা কামাল ও শহিদের ভগ্নিপতি হারুনর রশিদ সম্পন্ন করেন। স্বামীর চিকিৎসার কথা বলে চেকের মাধ্যমে ২০ লাখ ও নগদ ৫ লাখ সহ ২৫ লাখ টাকা নেয় তারা। কিন্তু চিকিৎসার বিষয়ে সুইটিকে আড়ালে রাখেন ওই তিনজন। পরবর্তি সময় স্বামীর মৃত্যু নিয়ে নানা ধরণের প্রশ্ন তৈরী হলে সুইটিকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেন ওই তিন ব্য্যক্তি। এক পর্যায়ে ২৬ জানুয়ারী রাতে শাহ আলম সুইটির বাসার চারিদিকে তালা লাগিয়ে দেয়।

সকাল বেলা একটি পকেট গেট খোলা থাকায় সুইটি বাইরে এসে দেখেন ৭টি গেটে তালা লাগানো। নিরাপত্তাকর্মীর কাছ থেকে সুইটি জানতে পারেন শাহ আলম তালা মেরে চাবি নিয়ে গেছেন। পরবর্তি সময় শাহ আলম শহিদের বাসায় অবস্থানরত শহিদের স্ত্রী ও সন্তানদের নজরবন্ধি করতে সিসি টিভির নিয়ন্ত্রনও নিয়ে নেয়। সুইইটি আরো জানান, তার স্বামীর মৃত্যুর পর শাহ আলমগং তার স্বামীর সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জোর করে দখল করেন। সকল উপার্জন বন্ধ ও নজরবন্ধী থাকায় সুইটি তিন সন্তান সহ নিজ বাসায় আটকা পড়ে যায়। পারিবারিকভাবে এই ঘটনার কারণ জানতে ব্যর্থ হয়ে সুইট স্বাক্ষরিত একটি সাধারণ ডায়েরী তার বাবা শেখ আব্দুর রাজ্জাকের মাধ্যমে ৩০ জানুয়ারী শ্রীপুর মডেল থানায় পাঠান। ওই রাতেই শ্রীপুর থানার এসআই সুমন সুইটির বাসায় আসেন এবং ঘটনা তদন্ত করেন। পরদিন ৩১ জানুয়ারী সুইটির বাবা শেখ আব্দুর রাজ্জাক শ্রীপুর থানার ওসির সাথে দেখা করলে ওসি, শাহ আলম গং এসেছিল বলে জানিয়ে বিষয়টি আপোষ করবেন বলে রাজ্জাককে জানিয়ে দেন।

এদিকে সুইটি যেন বাইরে যোগাযোগ করতে না পারেন সেজন্য শাহ আলমগং সুইটির বাসার ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। সুইটির দাবী, শাহ আলমগং তাকে ও তার তিন সন্তানকে তার স্বামীর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য যে কোন সময় হত্যা করতে পারেন। অথবা তাদেরকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করতে পারেন। বর্তমানে সুইটি তিন সন্তানসহ চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন দাবী করে সরকারের নিকট নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহবান জানান।

সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়. শহীদের ভাইয়েরা স্থানীয় এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের আহবান অমান্য করেছে। ফলে শাহ আলম গং এর ভয়ে তিন শিশু সন্তান সহ শহীদের স্ত্রী চরম নিরাপত্তা আতঙ্কে ভুগছেন। বিষয়টি নিয়ে শহীদের স্ত্রী স্থানীয় সাংসদের মাধ্যমে স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান বলে জানা গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *