যুদ্ধ থেমেছে। নতুন করে প্রাণ বা সম্পদহানির আশঙ্কা এ মুহূর্তে নেই। তবে যুদ্ধের এমন সব চিহ্ন আছে, যেসব মুছে গাজাবাসীর জন্য স্বাভাবিক জীবনে ফেরা কঠিন। এক লাখের মতো ফিলিস্তিন বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। চারদিকে এখনো স্পষ্ট যুদ্ধের ক্ষত। ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গাজার সর্বত্র।
বেশিরভাগ মানুষই রয়েছেন অস্থায়ী শেল্টারে। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে খবর আসে বাংলাদেশ পাসপোর্ট থেকে ‘একসেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দটি বাদ দিয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত ইউসূফ এস ওয়াই রামাদানের সঙ্গে। তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন আমাদের সময়ের সঙ্গে। বাংলাদেশ পাসপোর্ট থেকে ‘একসেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দটি বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত বলেন, এটা আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো বাংলাদেশের। আমি এটাকে রাজনৈতিকভাবে দেখতে চাই না। অপ্রত্যাশিত বলে বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ করব।
যুদ্ধবিরতিকে কীভাবে দেখেন- এমন প্রশ্নে ইউসূফ এস ওয়াই রামাদান বলেন, আমরা ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর বিশেষ করে নারী, শিশু ও নিরীহ মানুষের ওপর এই পাশবিকতা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ চায়। যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। কিন্তু যুদ্ধবিরতিই সমাধান না। কেন এটি ঘটবে। কেন ৬৯ শিশুকে মরতে হবে। ৪১ মাকে মরতে হবে। একই পরিবারের অনেক সদস্যকে কেন মরতে হবে। শিশুর চোখের সামনে কেন তার পিতা-মাতাকে মরতে দেখতে হবে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত বলেন, সমস্ত কিছু ঘটছে একজন লোকের কারণে। তিনি হচ্ছেন নেতানিয়াহু। উনি ইসরায়েলের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নেতা নন। ইসরায়েলের জনগণের কাছে নিজেকে হিরো হিসেবে প্রমাণ করতে চান। প্রমাণ করতে চান তিনি ইসরায়েলের জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারেন। তিনি ফিলিস্তিন জনগণ, হামাস ও সত্যের পক্ষে জিহাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন। সেজন্য যুদ্ধ শুরু করছেন; কিন্তু তিনি সফল হননি। ভবিষ্যতে যদি নেতানিয়াহু সরকার গঠন করতে না পারে, তা হলে জেলখানা হবে তার ঠিকানা। তার কারণ তার নামে ৫টি দুর্নীতির মামলা আছে। এ জন্য তিনি পেশিশক্তি প্রদর্শন শুরু করেছেন। যুদ্ধ শুরু করেছেন। যাতে ভোটে জিতে সরকার গঠন করতে পারেন। যুদ্ধবিরতি হয়েছে, সেটি ভালো। কিন্তু ফিলিস্তিন জনগণকে কেন দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোর বিভক্তিকে কীভাবে দেখেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোর বিভক্তি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন হারিয়েছি আরব বিশ্বের বিভক্তির কারণে। তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল না। তারা কখনো ঐক্যবদ্ধ হবে না। ঐক্যবদ্ধতা শক্তি। ইতিহাস সেটার প্রমাণ দেয়। মুসলমানরা যখন ঐক্যবদ্ধ ছিল, তখন তারা স্পেনসহ পুরো বিশ্ব শাসন করেছে। সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শতকে মুসলমানদের বিজয় কেতন উড়েছে। একজন প্যালেস্টাইন হিসেবে আমাদের পবিত্র দায়িত্ব মসজিদুল আকসা ও জেরুজালেমকে রক্ষা করা। ইসরায়েল সমস্ত প্যালেস্টাইন জবরদখল করে রেখেছে। শুধু গাজার ৩৬৩ বর্গকিলোমিটার বা ২০০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র অংশ দখলে নিতে পারেনি। আমাদের সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে অনবরত সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা-ওআইসির ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন- তার উত্তরে তিনি বলেন, আমি আগেই উল্লেখ করেছি, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সত্যিকারের ঐক্য নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এটা বলছে। কিন্তু এখন উপলব্ধির সময় হয়েছে- বিবৃতি, সেমিনার, মিটিং করে কাজ হবে না। কারণ ইসরায়েল এগুলোর পরোয়া করে না। আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে ইসরায়েল পরোয়া করে না। ইসরায়েল শুধু শক্তি প্রয়োগকে পরোয়া করে। এখন যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আলোচনা ও ফিলিস্তিন জনগণের প্রতি শুধু সহানুভূতি অব্যাহত রাখে কোনো কাজ হবে না। কারণ আমাদের শত্রু আইনের শাসন কী বোঝে না। আমেরিকার প্রশ্রয়ের কারণে তারা এমনটা করে। এটি দুর্ভাগ্যজনক, আমেরিকা সবসময় দ্বিমুখী নীতি নিয়েছে। একদিকে ইসরায়েল আমেরিকার সমর্থনে শক্তি সঞ্চয় করছে; অন্যদিকে আমাদের নিজেদের রক্ষার অধিকার নেই।
হামাস ও ফাত্তাহর মধ্য বিরোধ নিয়ে তিনি বলেন, যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সেখানে কোনো হামাস নেই কোনো ফাত্তাহ নেই। আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা এক ব্যক্তি, এক পতাকাতলে। আল মসজিদুল আকসা, জেরুজালেমের ছাতাতলে ফিলিস্তিনে এবং ফিলিস্তিনের বাইরে এবং রিফিউজি ক্যাম্পে আমরা ঐক্যবদ্ধ। সেখানে কেউ হামাস ও ফাত্তাহ নিয়ে আলোচনা করে না। আলোচনা এক ফিলিস্তিন নিয়ে এবং এতেই আমরা গর্বিত।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষের সমর্থনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের সংকটে বাংলাদেশের মানুষের এমন অভূতপূর্ব সাড়া পেয়ে আমরা সত্যি অবাক। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি প্রতিটি মানুষের প্রতি। বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতা অবশ্যই আমার দেশের মানুষ জানবে। বাংলাদেশের মানুষের এই আর্থিক সহযোগিতা আমরা চিকিৎসা খাতে ব্যয় করতে চাই। গাজায় মেডিক্যাল পণ্য সাপ্লাই দেওয়া কোম্পানিকে এই অর্থ দেওয়া হবে, যাতে হাসপাতালে চিকিৎসাকাজে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী কেনা যায়। আমরা বিশ্বাস করি, আমরা স্বাধীন ভূখ-ে একদিন ফিরব। বাংলাদেশের মানুষের সহযোগিতার কথা আমরা তখনো কৃতজ্ঞচিত্তে মনে করব।