ঢাকা: আজ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিন আবেদন নিয়ে আদেশ দেবেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মহানগর দায়রা জজ আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট মো. হেমায়েত উদ্দিন খান (হিরণ) মানবজমিনকে বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আসামি রোজিনার স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও ফুটেজসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আদালতে জমা দিবেন। এরপর বিচারক সেগুলো পর্যালোচনা করে সকাল ১০টার দিকে আদেশ দেবেন। এদিকে সাংবাদিক রোজিনার মুক্তির জন্য আটকের পর থেকেই আন্দোলন করে আসছেন বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন। গতকালকেও জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে মানবন্ধন করেছে সাংবাদিকদের তিন সংগঠন। কারাবন্দি রোজিনা ইসলাম মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন নারী সাংবাদিকরা। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) প্রাঙ্গণে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে ক্ষুব্ধ নারী সাংবাদিকেরা প্রতীকী অনশন কর্মসূচিতে এমন ঘোষণা দেন। রোজিনা ইসলামের জামিনে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলা
প্রত্যাহার এবং গণমাধ্যমবিরোধী কালাকানুন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন তারা।
রোজিনা ইসলামের মুক্তি এবং তার মামলা প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে করণীয় নির্ধারণে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বৈঠক করেন সাংবাদিকদের পাঁচটি সংগঠনের নেতারা। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে’র) একাংশের উদ্যোগে আয়োজিত এই বৈঠক প্রায় তিন ঘণ্টা চলে। সংগঠনগুলো হলো- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে নির্যাতন ও গ্রেপ্তারে ক্ষোভ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেছেন, সরকারের কিছু আমলা রোজিনা ইসলামের বিষয়টি নিয়ে সরকার ও গণমাধ্যমকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ অবস্থান থেকে সবার সরে আসার প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বলেছেন, রোববার রোজিনা ইসলাম আদালতের আদেশে মুক্ত হয়ে আসবেন বলে আশা করছেন। ঢাকার বাইরেও চলছে রোজিনা মুক্তির আন্দোলন। গতকাল বেলা ১১টায় কুষ্টিয়া শহরের পাঁচরাস্তার মোড়ে মুজিব চত্বরে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন কুষ্টিয়া জেলা মানববন্ধন করে। এ সময় বক্তারা বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়নি। বরং দেশে ও সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নীতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এটা দেশের জন্য অমঙ্গলকর। রোজিনার নিঃশর্ত মুক্তি এবং তাকে হেনস্তায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সাতক্ষীরা, রাজবাড়ীর কালুখালী, নড়াইলের লোহাগড়া ও পটুয়াখালীর বাউফলেও মানববন্ধন, সমাবেশ হয়েছে। এসব কর্মসূচি থেকে রোজিনা ইসলামকে মুক্ত না করা পর্যন্ত রাজপথে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন বক্তারা।
রোজিনা ইসলামকে হয়তো ফাঁদ পেতে ধরেছে: সত্য উদ্?ঘাটনের চেষ্টা করতে গিয়ে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম হয়রানি, নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। তার করা প্রতিবেদনের কারণে যাদের আঁতে ঘা লেগেছিল, তারাই হয়তো ফাঁদ পেতে তাকে আটক করেছে। সাংবাদিকেরা কখনো তথ্য চুরি করেন না। তথ্য উদ্ধার করেন, তথ্য সংগ্রহ করেন। আর সে তথ্য দেশের মানুষের কাজে আসে, সমাজের কাজে আসে, মানুষের কাজে আসে। গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তারা এসব কথা বলেন। এতে সংহতি জানান বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা। তারা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তারা প্রশ্ন তুলে বলেন, সচিবালয়ের মতো জায়গায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় ফাইল কেন অরক্ষিত অবস্থায় থাকবে। তাহলে তো ওই সব আমলার আগে চাকরি যাওয়া উচিত। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন বলেন, যারা সৎ কর্মকর্তা, তারা রোজিনা ইসলামদের সহযোগিতা করেন। আর যাঁরা অসৎ পন্থা অবলম্বন করেন, তাঁরা রোজিনা ইসলামদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। হয়রানি করার চেষ্টা করেন। সংবাদপত্রকে প্রতিপক্ষ ভাবেন। যখন সারা দেশে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে সাংবাদিকেরা রাজপথে নেমে এসেছেন, সেই সময়ে এই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আন্দোলন নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিকনেতা শহিদুল ইসলাম। তিনি এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলার আহ্বান জানান। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব পুলক ঘটক বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি বলছেন রোজিনার প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, এতে মুখ দেখানো যায় না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন রোজিনা সুবিচার পাবেন। আইনমন্ত্রী প্রথম দিনেই বলেছেন সাংবাদিক রোজিনা ন্যায়বিচার পাবেন। এটা কি ন্যায়বিচারের নমুনা? বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোল্লা জালাল বলেন, আশা করি রোজিনা ইসলামকে আগামীকাল নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হবে। তা না হলে নো-রিটার্ন হোম আন্দোলন শুরু করা ছাড়া উপায় থাকবে না। সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি মামুন ফরাজী বলেন, সাংবাদিকদের এই পরিণতির মূলে রয়েছে নিজেদের মধ্যে বিভক্তি। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন ধারায় যে আন্দোলন চলছে, প্রতিটি শক্তিকে একটা মোহনায় নিয়ে আসতে হবে।
এদিকে, কারাবন্দি রোজিনা ইসলাম মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকবেন নারী সাংবাদিকেরা। রোজিনা ইসলামের জামিনে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার এবং গণমাধ্যমবিরোধী কালাকানুন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন তারা। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) প্রাঙ্গণে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে ক্ষুব্ধ নারী সাংবাদিকেরা প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করেন। সেখানে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত এবং সাংবাদিক সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়া নারী সাংবাদিকেরা এসব কথা বলেছেন। এ কর্মসূচিতে প্রথম আলো পরিবারের সদস্যরা সংহতি জানান। এ ছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত পুরুষ সাংবাদিকেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেন। নারী সাংবাদিকেরা বলেন, ঘটনার পর থেকে কারও চোখেই ঘুম নেই। নারী সাংবাদিকেরা ঘটনার দিন থেকেই পথে আন্দোলন করছেন। রোজিনা ইসলামের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা মাঠে থাকবেন। রোজিনা ইসলাম এমন কোনো অপরাধ করেননি যে, তাকে কারাগারে রাখতে হবে। তাকে রোববার মুক্তি দেওয়া না হলে কঠোর থেকে কঠোরতর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তাও বন্ধের দাবি জানান তারা।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা কর্মসূচিতে নারী সাংবাদিকেরা বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে ‘আমার বোন রোজিনা, মুক্তি ছাড়া বুঝি না’, ‘সাংবাদিক জেলে কেন, প্রশাসন জবাব চাই,’ ‘প্রশাসনের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও,’ ‘দুর্নীতিবাজের আস্তানা, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’সহ বিভিন্ন স্ল্লোগান দেন। নারী সাংবাদিকেরা বলেন, রোজিনা ইসলাম ভুক্তভোগী, আসলে চেপে ধরা হয়েছে সাংবাদিকতাকে। সচিবালয়ে অবরুদ্ধ ঘরে রোজিনা ইসলাম ছিলেন একা, আর তার চারপাশে ছিল প্রশাসনের অনেক লোক। রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে নির্যাতন করার ঘটনা রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধী। আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে রোজিনা ইসলামের জামিন পাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।
সাংবাদিকনেতা শামীমা দোলা বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শেখাতে চাচ্ছেন। প্রেস রিলিজ ছেপে দেওয়াই কি সাংবাদিকতা? তিনি বলেন, সাংবাদিকেরা সরকার বা বিরোধী দলের বন্ধুও না, শত্রুও না। সঠিক সংবাদ তুলে ধরার জন্য সাংবাদিকের জায়গা কারাগার হতে পারে না।
ডিআরইউ’র বর্তমান নারীবিষয়ক সম্পাদক রীতা নাহার বলেন, ‘রোজিনার শুধু জামিন নয়, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং এ ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির পর আমরা বাড়ি ফিরবো। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে বলছি, রোজিনা ইসলামকে আর এক দিনও কারাগারে দেখতে চাই না। যারা দুর্নীতি করছে, অপরাধী তারা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক নারী সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখনই তো যে কেউ আপনাকে বা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। কোনো একটা জেলখানায় থাকলেন। এটা হলো জুলুমের লক্ষণ। যে সংহতি জানাতে এসেছি, তা বোনের জন্য, এমনকি আমাদের নিজেদের জন্যও। বৃহত্তর কারণে এসেছি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এসেছি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে এসেছি।
এর আগে বৃহস্পতিবার সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিন শুনানিকে ঘিরে সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় করেন সাংবাদিক ও আইনজীবীরা। ওইদিন সকালে তার জামিন শুনানি শুরুর কথা থাকলেও তিন দফা সময় পেছানো হয়। বেলা সাড়ে ১২টার পর শুনানি শুরু হয়ে ২টার পর তা শেষ হয়। কিন্তু আদালত জামিনের বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি। বলা হয় পরে আদেশ দেয়া হবে। বিকাল ৪টার দিকে আদালতের তরফে বলা হয়, রোববার আদেশ দেয়া হবে। দিনভর অপেক্ষা শেষে বিকালে হতাশা নিয়ে আদালত চত্বর ছাড়েন রোজিনার সহকর্মী ও স্বজনরা। গত সোমবার রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির চেষ্টায় রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এক কর্মকর্তার কক্ষে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। পরে রাতে তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করে বৃটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারায় মামলা করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। ওইদিন থেকেই রোজিনাকে মুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে সাংবাদিক সংগঠনগুলো। সাংবাদিক নেতারা এরইমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। মন্ত্রীরা আশা প্রকাশ করে বলেছেন ন্যায্য বিচার পাবেন রোজিনা।