বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অনেক আলোচিত প্রতিবেদনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে। কিন্তু দুনীতির এসব অভিযোগের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা কি নিয়েছে?
স্বাস্থ্যখাতে গত তিনমাসে নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য, কেনাকাটায় দুর্নীতি আর অনিয়মের অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে, যেসব খবরের কোনো প্রতিবাদও আসেনি সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে।
কিন্তু মহামারীর সময়ে এই খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির পরিমাণ অনেক বেড়েছে বলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি গত বছর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
টিআইবি বলছে, করোনাভাইরাস মহামারীকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির মহোৎসব হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে যে সাংবাদিক সবচেয়ে বেশি রিপোর্ট করেছেন, সেই রোজিনা ইসলামকে সম্প্রতি পাঁচ ঘণ্টা মন্ত্রণালয়ে আটকে রাখার পর অফিসিয়াল সিক্রেক্টস অ্যাক্টের এক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতে ১৮০০ চাকরির নিয়োগ নিয়ে কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাব, স্বাস্থ্যের সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম-এরকম অনেকগুলো প্রতিবেদন তৈরি করেছেন রোজিনা ইসলাম।
কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ? সেসব অভিযোগের ব্যাপারে কি খতিয়ে দেখা হয়েছে?
স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি আর অনিয়ম
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সঙ্কট শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থার চিত্রটি প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।
দরকারি উপকরণের অভাব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ, হাসপাতালে সেবার অভাব, নিয়োগ আর কেনাকাটায় একের পর এক দুর্নীতির খবর যেন এই খাতের বেহাল দশাকেই তুলে ধরেছে।
কিন্তু এসব অভিযোগ কতটা আমলে নিয়েছে স্বাস্থ্য খাতের কর্তাব্যক্তিরা?
স্বাস্থ্যখাত সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আ ফ ম রুহুল হক বলছেন, ‘দুর্নীতির কোনো অভিযোগ এলে সেটা দুর্নীতি দমন কমিশনে চলে যায়। এরপর আমরা সেখান থেকে কোনো তথ্য আর পাই না। আর গত কিছু দিনে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতির খবর হয়েছে, সেগুলো তো দুর্নীতি দমন কমিশন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দফতরের তদন্ত করে দেখার কথা। আমরা আশা করবো, কেউ না কেউ এসব দেখবে।’
তবে সুনির্দিষ্টভাবে এসব অভিযোগের কোনো তদন্ত চলছে বা হয়েছে কিনা, তা তার জানা নেই বলে জানান সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
দুর্নীতির তদন্ত কতটা হয়?
মাস্ক কেলেঙ্কারি, কোভিড টেস্ট নিয়ে জালিয়াতি, জেকেজি আর রিজেন্ট হাসপাতালের মতো বড় আর আলোচিত ঘটনার পরেও, গত তিন মাসেই স্বাস্থ্য খাতে ১৮০০ জনবল নিয়োগে কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব, শত শত কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর আবার বাংলাদেশের গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।
যে সাংবাদিক এই প্রতিবেদনগুলো করেছিলেন, সেই রোজিনা ইসলামকে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখার পর অফিসিয়াল সিক্রেক্টস অ্যাক্টের একটি মামলা করে কারাগারে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘এসব অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত বা ব্যবস্থা নেয়ার কোনো তথ্য তাদের জানা নেই।’
এসব অভিযোগের ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদফতর বা সরকারের তরফ থেকে কোনো বক্তব্য জানানো হয়নি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলছেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়া এবং মানুষের মুখে মুখে যেসব দুর্নীতির অভিযোগের কথা শোনা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রাথমিকভাবে প্রতিটা বিষয়ই আমলে নিয়েছে এবং তদন্ত করেছে।’
তিনি জানান, এরকম অনেক দুর্নীতির বিষয়ে তারা তদন্ত করেছেন, কিছু কিছুর প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে, কিছু এখনো তদন্তাধীন রয়েছে।
কিন্তু তাতে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির কতটা পরিবর্তন হয়েছে?
মোজাম্মেল হক খান বলছেন, ‘আমি যদি সততার সাথে বলি, তাহলে পরিবর্তন এখনো দৃশ্যমান হয়নি। তবে আমরা আশা করছিলাম এর চেয়ে ভালো অবস্থান আমরা দেখতে পাবো। তবে ভবিষ্যতে, আমাদের যেসব অনুসন্ধান চলছে, এ থেকে যদি ভালো একটা রেজাল্ট বের করে আনতে পারি, তাহলে অবশ্যই একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন আপনাদের দেখাতে পারবো।’
‘রুই-কাতলা সবসময়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়’
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৯ সালে একটি প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি মিলিয়ে দুর্নীতি বেশি হয়, এমন ১১টি খাত চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন।
গত বছরেই দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, করোনাভাইরাস সঙ্কটের সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আস্থার সঙ্কটে পড়েছে স্বাস্থ্য খাত। কিন্তু গণমাধ্যমে বড় বড় অনিয়ম-দুর্নীতি তথ্যপ্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশের পরেও কেন তেমন কোনো ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ চোখে পড়ে না?
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ‘যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত, সেখানে দুর্নীতি বা অনিয়মের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এরকম ক্ষেত্রে খুব কমই আমরা কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাই। বড় জোর বদলি হয়, যা আসলে কোনো পদক্ষেপ না। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকেও খুব যে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়, তা নয়। কখনো কখনো চুনোপুঁটি ছোটখাটো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়, যাদের রাজনৈতিক যোগসাজশ নেই। কিন্তু রুই-কাতলাদের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হতে দেখা যায় না।’
‘এই কারণে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে। আর এই মহামারীকে দুর্নীতির একটি মহোৎসবে পরিণত করা হয়েছে।’ বলছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
২০২০ সালের বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে দুই ধাপ নিচে নেমে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১২তম আর এই অবনমনের পেছনে করোনাভাইরাস মহামারীতে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক দুর্নীতিকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
টিআইবি বলছে, আমূল সংস্কারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতদের সঠিক শাস্তি না হওয়ার কারণেই এই খাত দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র : বিবিসি