লোভ সবারই আছে। টাকা ক্ষমতা আর বিলাসী জীবনের লোভ কার না নেই বলেন! তবুও একটি কথা ছিল যা এখন প্রায়ই নেই বললেই চলে। সাংবাদিক জাতির বিবেক। যার বিবেক আছে তিনি অপরাধ করতে পারেন না। আর সেই ধারণা থেকেই সাংবাদিকদের উপর জাতির বিশ্বাস স্থাপন হয়েছিল যে, সাংবাদিকেরা জাতির বিবেক। আর এই বিবেক অন্যায় দেখলে প্রতিবাদে গর্জে উঠবে। প্রতিবাদ দেখে অন্যায়কারীরা ভয় পাবে। কিন্তু আজ হিতে বিপরীত। জাতির বিবেক দাবীদার আমরা নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে গেলাম। নিজের সহকর্মীর রক্তমাখা লাশ বিক্রি করে আমরা ধনী লোক হয়ে যাই। আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপরাধীর সাথে মিশে বড় লোক হয়ে যাই। বাড়ি গাড়ি ও শিল্পপতি হই আমরা। এই আমরার কিছু অংশ এমন নজীর স্থাপন করার পর এখন হিড়িক পড়ে গেছে বড় লোক হওয়ার। চলছে জাতির বিবেকের বড় লোক হওয়ার হিড়িক। বর্তমানে সাংবাদিকতা একটি লাভজনক ব্যবসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতায় যাওয়া আসার মাধ্যম এখন মিডিয়া। কালো টাকার মালিকদের মাধ্যম মিডিয়া। কেউ বড় ধরণের অপরাধ করতে চাইলে প্রথমেই মিডিয়া নিজের করে নেয়। হয় মালিক হয়ে না হয় কিনে নিয়ে। মিডিয়ার মালিকানা অপরাধীর হাতে থাকলে ওই মিডিয়ার সাংবাদিকেরা তোতাপাখি হবে এটই স্বাভাবিক। কারণ মালিকের চাকুরী করে তার বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না।
মিডিয়ার মালিকানা সাংবাদিক নিয়ন্ত্রনের হাতিয়ার হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকেরা জাতির বিবেক, এটা বলা সহজ হবে না। কারণ বিবেকের চাবি নিজের কাছে নেই। অন্যের দ্বারা বিবেক নিয়ন্ত্রিত হলে বিবেক আর বিবেক থাকে না। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা হয়ে গেছে প্রায় রাজনৈতিক ও বানিজ্যিক। কারণ সাংবাদিকতা এখন অন্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাংবাদিক হওয়ার কথা ছিল জাতির বিবেক। কিন্তু সাংবাদিক এখন খন্ডিত বিবেক। খন্ডিত বিবেক মাঝে মধ্যে রক্তাক্ত হলে কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আর স্বাস্থ্যবান বিবেকের চাপে খন্ডিত বিবেকের রক্ত শুকিয়ে যায়। তখন প্রতিবাদ বন্ধ হয়ে যায়। সাংবাদিকেরা রাজনৈতিক হওয়ার কারণে আর মিডিয়ার মালিকানা সাংবাদিকদের হাতে না থাকায় অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে জাতির বিবেক আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এরপরও মাঝে মাঝে আশা জেগে উঠে, এই বুঝি জাতির বিবেক সুস্থ হয়ে উঠল। তবে সবই এখন স্বপ্ন। কারণ স্বপ্নের মধ্যেই আমরা বসবাস করি।
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানী আজ থেকে শুরু হয়নি। সব সরকারই নিজেদের প্রয়োজনে সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানী করেছে। আর সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন থাকায় এক প্ল্যাটফরমে প্রতিবাদ হয়নি। এই জন্যই সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানী বাড়ছে। সরকারগুলো সাংবাদিকদের বিষয়ে তেমন কোন চিন্তাই করছে না। সাংবাদিক রক্তাক্ত হয়ে খুন হলেও তেমন কোন বিচারও হচ্ছে না। শুধুমাত্র ঐক্য না থাকার কারণে। তবে মাঝে মাঝে ঐক্যের সুর বাজলেও অদৃশ্য কারণে তা মিলিয়ে যায়। অনৈক্যের কারণে সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানী তো বন্ধ করা যাচ্ছে না একই সাথে সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানী করার জন্য নতুন নতৃন আইন পুরাতন আইনের সঙ্গে মিলে বড় বড় আইনে পরিনত হচ্ছে। ঔপনিবেশিক আইন গুলোও এখন আমাদের সাথে যোগ দিয়ে ভয়ঙ্কর আইন তৈরী করছে। আর এসব কালো আইন বাতিলের দাবী করার যোগ্যতাও আমরা হারিয়ে ফেলছি দিন দিন। কারণ জাতির বিবেক এখন খন্ডিত রক্তাংশ। আর এই খন্ডিত অংশের সঙ্গে সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও আইনগুলো হচ্ছে এবং সাংবাদিক হয়ারনীও হচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না।
চলমান ইস্যুতে বলতে হয়, অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টে রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট মূলত একটি ঔপনিবেশিক আইন। ব্রিটিশ শাসনামলে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। আঠারোশ নিরানব্বই সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত লর্ড কার্জন যখন ভারতবর্ষের ভাইসরয় ছিলেন তখন এই আইন প্রণয়ন করা হয়। বেশ কয়েক-দফা সংশোধিত হয়ে ১৯২৩ সালে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট জারি করা হয়।
অতি সম্প্রতি বার্মার সামরিক জান্তা এই আইনটি ব্যবহার করে রয়টার্সের দুজন সাংবাদিককে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়। ফলে বার্মার সামরিক জান্তা সারা বিশ্বে নিন্দিত হয়। গণতন্ত্রের উচ্চকণ্ঠ বাংলাদেশও কি শেষ পর্যন্ত বার্মার কাতারে চলে গেল? এটা সত্যি দুঃখজনক। একথা বলতে হবে, গোপন কথাটি রবে না গোপনে। যে দুর্নীতি গোপন করতে চেয়েছিল ইংরেজরা, যে দুর্নীতি গোপন করার জন্য আমরাও উঠেপড়ে লেগেছি। এটা খুবই দুঃখজনক।
ইংরেজ শাসনামলে যে আইন করা হয়েছিল সত্য গোপন করার জন্য, অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭৩ সালে এই আইনটি বাতিল করতে সাংবাদিকদের দাবির সঙ্গে সরকার একমত হয়। অবাধ তথ্য প্রবাহ আইন করার সময় এই অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট-এর কার্যকারিতা স্থগিত করা হয় এবং সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয় আপাত এই আইনের কার্যকারিতা থাকবে না। কিন্তু ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এ এই সত্য গোপনের আইন জুড়ে দেয়া হয়।
করোনা মহামারির কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন দুর্নীতির খবর প্রকাশ হতে থাকে।
দুর্নীতিতে নিমজ্জিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং হাসপাতাল। আর এর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার জন্য সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে শারীরিক নির্যাতন করা হয় এবং অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টে তাকে আটক করা হয়। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এ ধরনের আইন অনেকদিন প্রয়োগ হয়নি। আমরা যখন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের সংশোধনীর জন্য আন্দোলন করি তখন সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে এই আইনটির সংশোধনের আশ্বাস দিয়েও পালন করা হয়নি। এই আইন সাংবাদিকতার ইতিহাসে নতুন ধারা সংযোজিত করেছে। আমার মনে হয়, এই আইনটি অবিলম্বে বাতিল করা উচিত এবং এই আইনের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টও বাতিল হওয়া উচিত। কারণ এই আইন যতদিন থাকবে ততদিন সাংবাদিক নির্যাতন চলবে। রোজিনা ইসলাম আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।
সাংবাদিকদের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট একটি ঘুমন্ত বাঘ। কিন্তু বাঘ এখন জেগে উঠেছে। বাঘ যখন জেগে উঠে তখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সেই বাঘকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়া। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের এগিয়ে আসতে হবে। সাংবাদিক সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমি খুশি হয়েছি সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার ফোরাম তাৎক্ষণিকভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়ায়। এটাই সঠিক পথ। এটাকে আরো শানিত করতে হবে। এখানে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি সত্য উদ্ঘাটনের জন্য সাংবাদিকতা করতে হয়, যদি সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য সাংবাদিকতা করতে হয় তবে কেউ তা করতে দেবে না, বাধা দেবে। বাধা উপেক্ষা করে রোজিনার মতো সাহস নিয়ে সাংবাদিকদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে আরো সোচ্চার হতে হবে। এটাই সুযোগ ডিজিটালি সিকিউরিটি অ্যাক্টের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার। কারণ এই কথা সরকারকে বুঝতে হবে যে, কথা গোপন করার জন্য যে আইন করা হয়েছিল, সেই গোপন কথাটি রবে না গোপনে। জনসমক্ষে বেরিয়ে আসবেই।
লেখক
রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী