পথে পথে বিড়ম্বনা, তবুও বাড়ি ফেরা !

Slider সারাদেশ


পথে পথে বিড়ম্বনা, নানা ঝক্কি-ঝামেলা ও চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি তবুও বাড়ি ফিরছেন ঘরমুখো মানুষ। কোনো বাধাই যেন তাদের আটকাতে পারছেন না। এমনকি দক্ষিণাঞ্জলের মানুষকে ঠেকাতে পদ্মা নদীর ফেরিঘাটগুলোতে বিজিবি মোতায়েন করা হলেও গ্রামের দিকের জন¯্রােত কমাতে পারছেন না। চলমান কঠোর লকডাউনে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও ঈদ সামনে রেখে নানান ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা ছাড়ছেন ঘরমুখো মানুষ। তবে অভিযোগ রয়েছে, রাতে পুলিশকে ম্যানেজ করে অনেক রুটের দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে।

রোববারও শত শত মানুষকে বিকল্প উপায়ে রাজধানীর গাবতলী ও সায়েদাবাদ এলাকা দিয়ে ঢাকা ছাড়তে দেখা গেছে। দূরপাল্লার বাস না থাকলেও এসব টার্মিনাল পয়েন্ট থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে নানা যানবাহনে করে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন তারা। সরকার কয়েকটি ফেরিঘাট বন্ধ ঘোষণা করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ফেরিঘাটগুলো থেকে মানুষকে ফিরিয়ে দিচ্ছে শুনেও কোনোভাবে ঢাকায় থাকতে চাইছেন না তারা। যেকোনো উপায়ে হোক গ্রামে ফেরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানা গেছে, দূরপাল্লার বাস না চললেও গাবতলী সায়েদাবাদ মহাখালী বাসটার্মিনালের সামনে গেলেই পরিবহন শ্রমিকরা বিভিন্ন প্রাইভেট গাড়ির হয়ে দালালি করে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এতে করে দালালি হিসাবে তারা জনপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ভাড়া করা গাড়ির মধ্যে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাক পিকআপ ভ্যান, নছিমন, মাহেন্দ্র, হিউম্যান হলার, সিএনজি অটোরিকশা ও বিভিন্ন রুটে চলাচলরত বাসের খোঁজ দিয়ে দিচ্ছেন তারা।

এসব বাহনে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ঠাসাঠাসি করে বাড়ি ফিরছেন যাত্রীরা। এ দিকে পদ্মা নদীর পাটুরিয়া, শিমুলিয়া ও বাংলাবাজার ফেরিঘাটে ঘরমুখো মানুষের ভীড় দেখা গেছে। যানবাহন তোলার আগেই ফেরি পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে মানুষে। অনেক সময় যানবাহন ছাড়াই শুধু মানুষ নিয়ে ফেরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

গতকাল গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে ঘরমুখো মানুষ প্রাইভেট কার, মাইক্রোবান, ট্রাক, পিকআপ ভ্যান এমনকি উবার-পাঠাও এ চলাচলরত মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলে করে পাটুরিয়া ঘাটে যাচ্ছেন। সেখান থেকে লোকাল বাসে করে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে যাচ্ছেন। টার্মিনালে থাকা বিভিন্ন বাস শ্রমিকরা যাত্রীদের সাথে কথা বলে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে প্রাইভেট গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে আগে যেখানে ৫০০ টাকায় খুলনা চলে যাওয়া যেত সেখানে পাটুরিয়া ঘাটে পৌঁছাতে প্রকারভেদে নেয়া হচ্ছে জনপ্রতি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা করে। বাকি পথে আরো খরচ রয়েছে।

আবার সায়েদাবাদ থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লাগামী যাত্রীরা বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ভাড়া করে যাত্রা শুরু করেছেন। কেউ কেউ লোকাল বাসে করে প্রতিটি জেলার শেষ সীমান্তে গিয়ে নামছেন। এরপর নছিমন করিমনে করে একটু সামনে এগিয়ে পরবর্তী জেলার লোকাল বাসে উঠে সেই জেলার শেষ সীমান্তে গিয়ে নামছেন। এতে করে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি, ঝামেলা, কষ্ট ও অর্থের দি হলেও তাদের কেউ ঠেকাতে পারছে না। এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় জন¯্রােত ঠেকাতে শিমুলিয়া ঘাটে মাইকিং করে ফেরি চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় তবুও এলাকায় যাত্রীরা ভিড় করছে পদ্মা পাড়ি দিতে।

মাগুরাগামী শামসুল ইসলাম গাবতলী থেকে জানান, একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। কিন্তু করোনায় লোকসান হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই বেকার অবস্থায় বাসা ভাড়া করে ঢাকায় থাকার খরচ জোগান দিবো কিভাবে। তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো আবার ঢাকায় ফিরব। গার্মেন্টস শ্রমিক আল আমিন বলেন, করোনায় গার্মেন্টস বন্ধ হওয়ার পর তিনি রিকশা চালাতে শুরু করেন। কিন্তু ঈদের বন্ধে রিকশায় যাত্রী পাওয়া যায় না। তাই ঢাকায় ঝামেলা না বাড়িয়ে গ্রামের দিকে ছুটছেন।

একজন প্রাইভেট কারচালক বলেন, গত ১৪ এপ্রিল কঠোর লকডাউন ঘোষণার আগের দিন মানুষ ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছিল। মাঝে কিছুটা কম হলেও গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আবার ছুটতে শুরু করেছে ঘরমুখো মানুষ। তিনি বলেন, উবারে গাড়ি চালালেও ঘরমুখো মানুষের ভিড় থাকায় অ্যাপস বন্ধ করে ভাড়ায় গাড়ি চালাচ্ছেন। তার প্রাইভেট কারে সামনে একজন ও পেছনে চারজন নিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে নামিয়ে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে জনপ্রতি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা ভাড়া আদায় করছেন। এত বেশি টাকা কেন নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশের বাধার কারণে টার্মিনালের আশপাশে অবস্থান করে যাত্রী তোলা যাচ্ছে না। যার কারণে টার্মিনালের কিছু লোক দালালি করে যাত্রী একত্র করছেন।

এরপর তাকে ফোন করলেই তিনি দ্রুত গাড়ি নিয়ে এসে যাত্রী তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ওই দালালদের যাত্রীপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। আবার রাস্তায় পুলিশে ধরলে সেখান থেকে ছাড়া পেতেও ৫০০-১০০০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে তার খুব একটা লাভ হচ্ছে না।

মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত ঘাটে জড়ো হয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ। মানুষের চাপ সামলাতে না পেরে ফেরিঘাট থেকে ফেরিগুলো সরিয়ে মাঝ নদীতে নোঙর করে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। রোববার ভোর থেকে তারা শিমুলিয়া ঘাট ও পদ্মা সেতুর টোল প্লাজারের কাছে দায়িত্ব পালন করছে।

এ বিষয়ে মাওয়া নৌপুলিশ ইনচার্জ সিরাজুল কবির জানান, সকাল থেকে এ পর্যন্ত চারটি ফেরি ছেড়ে গেছে মাওয়া ঘাট থেকে। পাঁচটি ফেরি চলাচল করছে। তবে অ্যাম্বুল্যান্স বা বিশেষ প্রয়োজনীয় গাড়ি এলে ফেরি ছেড়ে যাচ্ছে। এদিকে সকাল থেকেই ঈদে ঘরমুখো মানুষের ঢল ও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ফেরিঘাটের প্রায় এক কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়া ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ সদস্যদের (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। তবে বিজিবির চেকপোস্ট ভেদ করেই ঘরমুখো মানুষ ফেরিঘাটে ভিড় করছে।

তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির মধ্যে হাজার হাজার মানুষ বেপরোয়াভাবে শিমুলিয়াঘাটে এসে ফেরিতে পদ্মা পার হচ্ছেন। যা ঠেকাতে পুলিশকে সহযোগিতা করবে বিজিবি। এক প্লাটুন পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার কাছে রয়েছে, আরেক প্লাটুন রয়েছে শিমুলিয়াঘাটে।’ সকাল থেকেই ফেরিতে উঠতে বাধা দিচ্ছিল বিজিবি। তারপরও জোর করে ফেরিতে উঠে যাত্রীরা।

এ ব্যাপারে শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) ফয়সাল আহম্মেদ জানান, যখনই অ্যাম্বুল্যান্স আসছে আমরা তা পার করে দেয়ার চেষ্টা করছি। আর অ্যাম্বুল্যান্স পার করতে গিয়েই যাত্রীরা জোর করে উঠে পড়ছে ফেরিতে। উল্লেখ্য, গত শনিবার মধ্যরাতে দিনের বেলা ফেরি বন্ধ রেখে রাতে পণ্যবাহী যানবাহন পারের ঘোষণা দেয় বিআইডব্লিউটিসি। এরপরও ঈদে ঘরমুখো মানুষের অত্যধিক চাপ বাড়ে শিমুলিয়াঘাটে। চাপ সামাল দিতে দিনে পাঁচটি ফেরি চলাচল করে।

পাটুরিয়া-আরিচা ঘাটে ফেরি-লঞ্চ-স্পিডবোর্ড চলাচল বন্ধ
মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে সময় বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে ঈদে ঘরমুখী যাত্রীদের চাপ। অন্য দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাড়ছে যানবাহনের চাপ। গতকাল রোববার সকাল থেকেই ঘাট এলাকায় যাত্রীদের ফেরাতে পুলিশের তৎপরতা লক্ষ করা গেছে এবং সেই সাথে চলছে বিজিবির চেকপোস্ট। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে টহল দিচ্ছে পুলিশ ও বিজিবি।

গত কয়েক দিন ধরে সরকারের বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে মানুষ পাটুরিয়া ঘাটে পারের অপেক্ষায় ভিড় করে। তবে আজ পাটুরিয়া ঘাটের প্রবেশপথে মহাসড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে বিজিবির চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। লাশ ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স বাদ দিয়ে সব ধরনের যানবাহন ও যাত্রী পারাপার বন্ধ রয়েছে। পাটুরিয়া ও আরিচা ঘাটে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোড চলাচল বন্ধ রয়েছে।

শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম রুহুল আমীন রিমন বলেন, পাটুরিয়া ঘাটের প্রবেশদ্বারে মহাসড়কের টেপড়া বাসস্ট্যান্ডে বিজিবি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এ সময় যাত্রী ও যানবাহন ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ কবির বলেন, লাশ ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া ফেরিতে অন্য যানবাহন ও যাত্রী পারাপার বন্ধ রয়েছে। পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় যাত্রীদের ঠেকাতে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতিটি ঘাটে পুলিশ টহল দিচ্ছে।

বিআইডাব্লিউটিসির পাটুরিয়া ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক মহীউদ্দীন রাসেল বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে সকাল থেকেই ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। শুধু দু’টি ছোট ফেরি দিয়ে লাশ ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স পারাপার করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *