ঢাকা: বাংলাদেশ শুধু নয়, কয়েকশ বছরের ঐতিহ্য রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ১৬১০ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবেদার ইসলাম খাঁর সময়ে ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে উদ্যান গড়ে ওঠে, তা-ই আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিতি পায়, পাকিস্তান আমলেও ছিল তাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়, আরেক অংশ হয় রমনা পার্ক। প্রায় দুই কোটি মানুষের ঢাকা নগরে ‘ফুসফুস’ হিসেবে বিবেচিত এই দুই উদ্যান। এই উদ্যানেই ঐতিহাসিক ভাষন দিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
প্রায় দুই কোটি মানুষের ঢাকা নগরে ‘ফুসফুস’ হিসেবে বিবেচিত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। খাবারের হোটেল ও হাঁটার রাস্তা তৈরির জন্য কাটা হচ্ছে উদ্যানের গাছ। সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে বেশ কিছু গাছ কাটা হয়েছে এবং কাটার জন্য কিছু গাছ চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতিকেন্দ্র’ গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘কিছু গাছ’ কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পীঠস্থান। এখানে জাতির পিতা ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছেন; কিন্তু উন্নয়নের নামে এই মহামারীর মধ্যে উদ্যানের ৫০ বছর বয়সী শতাধিক গাছ রাতারাতি কেটে ফেলেছে গণপূর্ত বিভাগ। এখানে খাবারের দোকান বানানোর নামে প্রকৃতি হত্যার একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে করপোরেট সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছে, যার মূলে রয়েছে লুটপাটের অশুভ উদ্দেশ্য।
সরেজমিন দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে সাতটি রেস্টুরেন্ট করার কাজ চলছে। এ ছাড়া রাস্তা নির্মাণের কাজও চলমান। এ জন্য বেশ কিছু গাছ কাটা হয়েছে। গাছের গোড়াগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণকাজের পাশেই অনেক গাছে লাল ক্রস দাগ দেওয়া রয়েছে। এগুলো কাটা হতে পারে বলেও জানান নির্মাণশ্রমিকরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্প্রতি গাছ কাটার মধ্যে প্রবেশ পথের দেয়ালে কেউ লিখে রেখেছেন- ‘গাছ কাটা চলবে না’।
২০০৯ সালে উদ্যান সংক্রান্ত হাই কোর্টের একটি রায় ছিল। সে রায়ে বলা হয়েছে- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিছক একটি এলাকা নয়। এই এলাকাটি ঢাকা শহর পত্তনের সময় থেকে একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই এলাকার ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য আছে। শুধু তা-ই নয়, দেশের সব গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র এই এলাকা। ফলে সম্পূর্ণ এলাকাটি একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের দাবি রাখে।
সারাদেশে গাছের তথা বনাঞ্চলের পরিমাণ দিন দিন কমছে, যেখানে একটি ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকার কথা, সেখানে তা কমে গিয়েছে। দ্য স্টেট অব গ্লোবাল ফরেস্ট-২০১৮ বলেছে, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। অপরদিকে মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি। কারণে-অকারণে আজ বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে সেই বনভূমির পরিমাণ আরও কম। বসবাসের অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়।
বিশ্লেষনে দেখা যায়, সম্প্রতি আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ। ভোটের প্রয়োজনীয়তা কমে যাওয়ায় সভা সমাবেশের উপরও বিধি নিষেধ। বিরোধী দল এই ঐতিহাসিক উদ্যানে একটি সমাবেশ করারও অনুমতি পায়নি। রাজনীতির মঞ্চ হিসেবে গড়ে উঠা বাংলাদেশের গনতন্ত্রের একমাত্র বড় মঞ্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটায় কি ইঙ্গিত আসল, তা বোধগম্য নয়। এ ছাড়া অক্সিজেনের অভাবে মহাভারত যেখানে মৃত্যুপুরি সেখানে আমরা গাছ কেটে অক্সিজেনের উৎস নষ্ট করছি। অনেকে বলছেন, গনতন্ত্রকে পুরোপুরি অনুপস্থিত করতে এই আয়োজন। যদি তাই হয়, তবে গাছহীন ঢাকা অক্সিজেন সংকটে পড়লে অক্সিজেনহীন মানুষ কি বাঁচবে! তাহলে গনতন্ত্রের মঞ্চে তৈরী রেস্তোরাঁয় কাষ্টামার আসলে অক্সিজেন ছাড়া বাঁচবে কি করে?