ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা। করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন স্বাস্থ্যকর্মী রুনু। করোনায় সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে গত ২৭শে জানুয়ারি দেশে সর্বপ্রথম টিকা নিয়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণে নতুন অধ্যায় শুরু করেন। এদিকে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ২০০১ জন নার্স করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সম্প্রতি রুনু ভেরোনিকা কস্তার সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় মানবজমিনের। রুনু বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সকলের জন্যই খারাপ। এবারের ভাইরাসের চরিত্রটা গত বছরের তুলনায় খুব শক্তিশালী। এখন একবার পজেটিভ হলে দ্বিতীয়বার নেগেটিভ হতে অনেক বেশি সময় নিচ্ছে।
দুটোর মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে প্রথমবার যাদের মধ্যে ক্রনিক ডিজিজ ছিল, বয়স্ক ব্যক্তি তাদের বেলায় ক্ষতিটা বেশি হয়েছে। এবার বয়স ভিত্তিতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নেই। ছোট-বড় সকলেই আক্রান্ত হচ্ছে।
করোনাকালে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন সম্পর্কে তিনি বলেন, দুই শিফটে ১২ ঘণ্টা করে টানা ১৫ দিন কাজ করতে হয়। এরপর ১৫ দিন আইসোলেশনে থাকতে হয়। আমি মূলত ডায়ালাইসিস ইউনিটে কাজ করি। গত ১৫ দিনে ডিউটি করতে গিয়ে ৩৫ বছর বয়সের একজন রোগীকে চোখের সামনে চলে যেতে দেখেছি। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। ৩৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি কোভিড পজেটিভ হওয়ার পরে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেয়ার এক পর্যায়ে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর কয়েকদিনের মধ্যে তার কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। হাত-পা ফুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এ সময় তার আইসিইউ বেড প্রয়োজন ছিল। চিকিৎসকদের সিদ্ধান্তে ডায়ালাইসিস করা হয়। আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই। অক্সিজেন সেচুরেশন ৮৮ থেকে ৮৯-এ ওঠানামা করছিল। ডায়ালাইসিস দিতে গিয়ে রোগীর এত কষ্ট হচ্ছিল যেটা দেখে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। প্রথমত, তাকে আমরা আইসিইউ দিতে পারছি না। কিন্তু একজন নার্স হিসেবে জানি এই মুহূর্তে একটি আইসিইউ বেড খুব জরুরি তার জন্য। অক্সিজেন দিয়ে আমি রোগীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একজন রোগীকে আমরা সর্বোচ্চ ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে পারি।
তিনি বলেন, ৬ মাস বয়সী শিশুকে আত্মীয়ের কাছে রেখে আক্রান্ত ব্যক্তির স্ত্রী প্রাণপণে চেষ্টা করছেন স্বামীকে সারিয়ে তুলতে। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় স্বজনরা কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। অনর্গল কান্না করছিলেন। একটু পর পর দৌড়ে এসে বলছিলেন, সিস্টার দেখেন আমার স্বামী কেমন করছে।’ আমি তো দেখছি তিনি কেমন করছেন। তার কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু এরপরে তো আর আমার কাছে কিছু করার নেই। ডায়ালাইসিস শেষে করোনা ইউনিটে যাওয়ার পরদিন সে মারা যায়। ওই মুহূর্তে তার কষ্ট দেখে একজন নার্স হিসেবে নয় রোগীর স্বজন হয়ে কষ্টটা অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। প্রতিনিয়ত এরকম অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হতে হচ্ছে। করোনায় আমাদের ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু নেই উল্লেখ করে রুনু বলেন, দীর্ঘ এক বছর পরে এসে বলবো সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে আমার পরিবার যে সেক্রিফাইস করেছে সেক্ষেত্রে একজন স্ত্রী ও মা হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করছি। কারণ পরিবারের সদস্যদের মোটিভেট করতে সক্ষম হয়েছি। প্রথমবারের মতো যখন শিশু সন্তানকে রেখে হোটেলে কোয়ারেন্টিনে চলে যাই তখন আমি তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি আমি মানুষের জন্যই তোমাদের থেকে দূরে আছি। এ সময় আমার স্বামী আমাকে একটি কথাই বলেন, পৃথিবীর সকল মানুষ যদি মরে যায়, তুমি-আমি বেঁচে কি হবে? তার চেয়ে বরং এই মানুষগুলোকে বাঁচাতে গিয়ে যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় মনে করবো এটা ঈশ্বরের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য আশীর্বাদ।