বেওয়ারিশ লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। শনাক্ত করতে না পারার কারণে বেওয়ারিশ হিসেবেই দাফন হয়ে যাচ্ছে এসব লাশ। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই প্রতি বছর গড়ে দেড় হাজারের মতো বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যায়। আর সেসব লাশে আঘাতের ধরন এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্ট মিলিয়ে শতকরা ৮০ ভাগই হত্যাকাণ্ড বলে প্রতীয়মান হয়। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এসব হত্যাকাণ্ড কি কারণে ঘটছে ওই বিষয়টি অজানাই থেকে যাচ্ছে। চলমান অবরোধ ও হরতালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় বেওয়ারিশ লাশও বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই দুই থেকে তিন জনকে ক্রস ফায়ারে দেয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেককেই শনাক্ত করা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে লক্ষ্মীপুর, চাঁপাই নবাবগঞ্জ বা নড়াইল থেকে আটক করে ঢাকায় ক্রস ফায়ার দেয়া হচ্ছে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে পরিচয় শনাক্ত হচ্ছে না। বর্তমানে শনাক্তহীন বেওয়ারিশ লাশগুলোর বেশির ভাগগুলোতে গুলির চিহ্ন রয়েছে। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ গত ১৯ মাসে রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া দুই হাজার ১১৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এ হিসেবে গড়ে প্রতি মাসে ১১১টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। অর্থাৎ প্রতি দিন চারটি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হচ্ছে। সর্বশেষ ছয় মাসের মধ্যে অক্টোবরে রেকর্ডসংখ্যক ১৪৪ জনকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে আঞ্জুমান। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ৭৪টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়েছে। আর এ মাসে গতকাল পর্যন্ত আটটি লাশ দাফন করেছে তারা। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর মতে, লাশ শনাক্তে পুলিশের যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়ছে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। একস্থানে হত্যার পর অন্যস্থানে লাশ ফেলে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের সহকারী পরিচালক (সার্ভিসেস) মো. আবদুল হালিম মানবজমিনকে জানান, গত ১৯ মাসে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া দুই হাজার ১১৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। পরে পরিচয় শনাক্তের জন্য আঞ্জুমানের পক্ষ থেকে বেওয়ারিশ লাশের কোন নমুনা ও ছবি সংরক্ষণ করা হয় না। পুলিশ বেওয়ারিশ ঘোষণা করলে আঞ্জুমান তা দাফন করার দায়িত্ব নেয়। তিনি বলেন, বেশির ভাগ লাশই হস্তান্তর করা হয় গলিত অবস্থায়। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া হতভাগ্যদের মধ্যে বেশির ভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। পুলিশের কাছে বেওয়ারিশ লাশের ছবি ও পোশাক সংরক্ষণ করা থাকে। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের তথ্য মতে, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৩২৫টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে আজিমপুর ও জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর মধ্যে ২০১৩ সালের জুলাইতে ১১৩, আগস্টে ৯৯, সেপ্টেম্বরে ৮৯, অক্টোবরে ১৩৮, নভেম্বরে ১০২, ডিসেম্বরে ৯৫টি লাশ দাফন করা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ১০৩, ফেব্রুয়ারিতে ১০৯, মার্চে ১১৯, এপ্রিলে ১২০, মে ১৩১ ও জুন মাসে ১০৭টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। এদিকে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৭৯০ লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। এ হিসেবে ২০১৪ সালের জুলাইতে ১১৬, আগস্টে ১১০, সেপ্টেম্বরে ১১৮, অক্টোবরে ১৪৪, নভেম্বরে ১১৫, ডিসেম্বরে ১১৩, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ৭৪টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। আর গত পাঁচ দিনে আটটি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এদিকে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত ১ হাজার ১৮১টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে আজিমপুর ও জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর মধ্যে ২০১১ সালের জুলাইতে ১২৭, আগস্টে ১০৯, সেপ্টেম্বরে ১১১, অক্টোবরে ১০০, নভেম্বরে ১১২, ডিসেম্বরে ৭৬টি লাশ দাফন করা হয়। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ১১৫, ফেব্রুয়ারিতে ৮৩, মার্চে ৯৭, এপ্রিলে ৭৭, মে-তে ৯০ ও জুন মাসে ৮৪টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। এছাড়া ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৪৯৫টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। এর মধ্যে রানা প্লাজা ও তাজরীন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় ৩৪৪টি। ওই হিসেবে এ দুই ঘটনা বাদ দিলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ১৪৮টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। যদিও রানা প্লাজা ও তাজরীনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৪০টি লাশের ডিএনএ টেস্টের মাধ্যেমে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এ হিসেবে ২০১২ সালের জুলাইতে ১১৩, আগস্টে ১২৮, সেপ্টেম্বরে ১১০, অক্টোবরে ১১৫, নভেম্বরে ১৪৫ (তাজরীন ঘটনায় ৫৩ জনসহ), ডিসেম্বরে ৯০, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৯২, ফেব্রুয়ারিতে ৮৫, মার্চে ৯০, এপ্রিলে ৭২, মে ৩৬৭ (রানা প্লাজার-২৯১ জনসহ) ও জুন মাসে ৮৮টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। বেওয়ারিশ লাশের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, প্রতিটি বেওয়ারিশ লাশেরই সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত হয়। আর তা থেকে তারা জানেন এই বেওয়ারিশ লাশের শতকরা ৮০ ভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার। তারা এসব লাশের ছবি সংরক্ষণ করেন। তবে তাতে তেমন কাজ হয় না। অধিকাংশ লাশেরই পরে আর পরিচয় জানা যায় না। তিনি জানান, যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তারা নিজেরা দায় থেকে বাঁচতেই হয়তো বিকৃত করে এক এলাকার লাশ অন্য এলাকায় নিয়ে ফেলে। আবার কখনও লাশ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে। এসব লাশের অধিকাংশের শেষ পর্যন্ত পরিচয় জানা যায় না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে গুলিবিদ্ধ ও দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহতদের মধ্যে নয়টি লাশের কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি। পরিচয় না পেয়ে লাশগুলো আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করা হয়। অজ্ঞাত লাশের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে ৩রা জানুয়ারি একটি, ৫ই জানুয়ারি একটি, ১৯শে জানুয়ারি একটি, ২০শে জানুয়ারি একটি, ২৫শে জানুয়ারি দুটি, ২৭শে জানুয়ারি একটি, ২৮শে জানুয়ারি একটি ও ২৯শে জানুয়ারি একটি লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। এরপর তা আঞ্জুমান মুফিদুলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া লাশের মধ্যে বেশির ভাগ বয়সে তরুণ। অন্য লাশের মধ্যে ট্রেনে কাটা, সড়ক দুর্ঘটনা, হত্যা ও অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। এসব মরদেহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির পর এক সপ্তাহ লাশ সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল মর্গে সংরক্ষণ করা হয়। পরে সেখানেও সংশ্লিষ্ট থানায় পরিচয় শনাক্ত না হলে পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হস্তান্তরের সময় লাশ উদ্ধারের তারিখ, স্থান ও সংশ্লিষ্ট থানার নাম দেয়া হয় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামকে। পরবর্তীতে এই সূত্র ধরেই আঞ্জুমানের সাহায্যে কবর শনাক্ত করা হয়। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করতে গড়ে ১১০০ টাকা খরচ হয়। এ খরচ তারা নিজেদের পক্ষ থেকেই করে থাকেন। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী এবং এর উপকণ্ঠ থেকেই উদ্ধার করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি বেওয়ারিশ লাশ। এর মধ্যে মিরপুর বেড়িবাঁধ, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর রেললাইনের দু’পাশ, ডেমরা, শ্যামপুরের ওয়াসা পুকুরপাড়, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট ও কেরানীগঞ্জ থেকে প্রতি মাসে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার হয়েছে। লাশের হত্যার পর কারও শরীর থেকে হাত-পা ও কারও মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয়। আবার কারও চোখ উপড়ে এবং মুখ বিকৃত করে লাশ বস্তাবন্দি করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বেওয়ারিশ লাশ সম্পর্কে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার জন্য কেউ এ দুনিয়াতে জন্মায়নি। রাষ্ট্র কোনভাবেই বেওয়ারিশ লাশের দায় এড়াতে পারে না। তাদের দায়িত্ব হলো তদন্ত করে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির মুখোমুখি করা। আর তা করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। সে সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। তিনি বলেন, অনেকে শহরমুখী হচ্ছে। শহরে এসে নানা কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে। ফলে তাদের চেনাজানা বা পরিচিত কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আমি মনে করি, বেওয়ারিশদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করলে কয়েক জনের হলেও পরিচয় শনাক্ত করা যাবে।