ঢাকা: পুঁজি নিজের সৌন্দর্য। সেইসঙ্গে মডেল, অভিনেত্রী তকমা। এটিকে পুঁজি করেই রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে চেয়েছিলেন তিনি। বিকাল থেকে গভীর রাত কাটতো ঢাকার অভিজাত পাড়ায়। প্রেম, বন্ধুতা ও রূপের জালে ফাঁসিয়ে প্রবাসী কামরুল ইসলাম জুয়েলসহ অনেকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অর্থ। এমনকি টার্গেটকৃত বিত্তশালীকে বাসায় ডেকে অচেতন করে ধারণ করেন নগ্ন ছবি। ওই ছবি দিয়েই ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এরকম নানা অভিযোগ পুলিশের কাছে এলেও সামাজিক কারণে মামলা করছেন না ভুক্তভোগীরা।
প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ ও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে মামলা হলেও এতে মোটেও শঙ্কিত না স্বর্ণা। গত ২৪শে এপ্রিল রিমান্ডে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব বিষয়ে স্বর্ণা জানিয়েছেন, জুয়েলের অর্থ তিনি প্রতারণা করে নেননি। স্ত্রী হিসেবে ভোগ করেছেন। অন্য যারা অভিযোগ করেছেন তারা প্রত্যেকেই প্রয়োজনে তাকে ব্যবহার করেছেন। এমনি এমনি কেউ তাকে অর্থ দেয়নি। এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন স্বর্ণা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ২০-৩০ ব্যক্তির কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ লুটে নিয়েছেন স্বর্ণা। স্বর্ণা গ্রেপ্তারের পর এরমধ্যে বেশ কয়েক জন পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন। স্বর্ণার তিনটি মোবাইলফোন নম্বর রয়েছে। এরমধ্যে একটি নম্বর ব্যবহার করতেন গোপনে। বিশেষ করে তার স্বামী জুয়েলের আড়ালে ওই ফোনটি ব্যবহার করতেন তিনি। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বর্ণার ওই ফোনে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, পুলিশের কয়েক বিসিএস ক্যাডার অফিসার, দু’জন পরিচিত সাংবাদিক ও কয়েক ব্যবসায়ীর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। স্বর্ণা গ্রেপ্তারের পর তাদের অনেকেই আর তার খোঁজ নিচ্ছেন না। এ নিয়ে রিমান্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিনেত্রী রোমানা স্বর্ণা। স্বর্ণার সঙ্গে ধনাঢ্যদের বন্ধুতা করিয়ে দিতেন মারুফ আহমেদ খান রিজভী নামে এক ব্যক্তি। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় বা রাতে বনানী, গুলশান বা নিকেতনে রিজভীর সঙ্গে দেখা করতেন স্বর্ণা।
নির্দিষ্ট কোনো পেশা না থাকলেও স্বর্ণাসহ কয়েক সুন্দরী অভিনেত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন আড্ডার আয়োজন করেন কুষ্টিয়ার এই বাসিন্দা। প্রায়দিনই ব্যবসায়ী, প্রযোজক বা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের যেকোনো একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন রিজভী। গুলশান ও বিমানবন্দর সড়ক সংলগ্ন একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আড্ডা হতো তাদের। এক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের বিল পরিশোধ করতেন রিজভীর সঙ্গে থাকা অতিথি। কখনো কখনো স্বর্ণা চলে যেতেন কলকাতায়। এসব বিত্তশালীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন স্বর্ণা। নগদ উপহার পেলেও বিভিন্ন সময়ে আর্থিক নানা সমস্যা, সংকটের কথা জানিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা নিতেন এই অভিনেত্রী। গত জানুয়ারি মাসে স্বর্ণার সঙ্গে মোবাইলফোনে রিজভীর কথা হয়েছে ৬২ বার।
এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে স্বর্ণা জানিয়েছেন, রিজভী তার ভালো বন্ধু। রিজভীর মাধ্যমেই কয়েক জন সরকারি চাকরিজীবী, পুলিশের কয়েক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। বিভিন্ন সময়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত এই শ্রেণির ব্যক্তিদের সহযোগিতা নিয়েছেন রোমানা স্বর্ণা। স্বর্ণা জানিয়েছেন, রিজভী ছাড়াও অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। অনেকের সঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে পরিচয় হয়েছে। তবে তাদের নগ্ন ছবি ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল বা তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের প্রতারণা করেননি তিনি।
স্বর্ণার স্বামী ও মামলার বাদী কামরুল ইসলাম জুয়েল জানান, স্বর্ণাকে বিপথগামী করেছে রিজভী। গত বছরের ডিসেম্বরে বনানীর ১১ নম্বর সড়কের একটি রেস্টুরেন্টে স্বর্ণাকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন রিজভী। সেখানে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল তাদের। এরমধ্যেই খবর পেয়ে সেখানে হাজির হন জুয়েল। এ নিয়ে সেখানে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশকে জানালে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে রিজভী। এসব বিষয়ে কামরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, রিজভীর নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। সে স্বর্ণার মতো অনেক সুন্দরী মেয়েকে বিভিন্ন জনের কাছে নিয়ে যায়। স্বর্ণাকে বিপথগামী করেছে সে। আমি তার বিরুদ্ধে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের তথ্য দিয়েছি।
কামরুল ইসলাম জুয়েলের অর্থ আত্মসাৎ বিষয়ে স্বর্ণা জানিয়েছেন, এই অর্থ ফেরত দিবেন না তিনি। আদালত যে শাস্তি দেন তাই মাথা পেতে নিবেন। স্বর্ণা দাবি করেছেন, জুয়েল তাকে বিয়ে করেছেন। বর হিসেবে তাকে তা উপহার দিয়েছেন। এদিকে জুয়েল জানান, নানা অজুহাতে আমার কাছ থেকে এক কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে স্বর্ণা। টাকাগুলো ফেরত দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা ফেরত না দিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছে। সৌদি প্রবাসী কামরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, আমার সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। এখন আমি আমার অর্থ ফেরত চাই এবং প্রতারণার দায়ে স্বর্ণা ও তার সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক দুলাল হোসেন জানান, প্রতারণা, নগ্ন ছবি-ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে স্বর্ণাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। অনেক বিষয় এড়িয়ে গেছেন।
উল্লেখ্য, ফরিদপুর জেলা সদরের দক্ষিণ টেপাখোলার এটিএম নজরুল ইসলামের মেয়ে রোমানা স্বর্ণা। তন্ময় তানসেনের রানআউট ফিল্মে অভিনয় সহ বিভিন্ন নাটক, বিজ্ঞাপন ও শর্টফিল্মে অভিনয় করেছেন তিনি। ২০১৭ সালে নিজ এলাকার ছেলে তানভীর ইউসুফকে ডিভোর্স দেন এক সন্তানের জননী স্বর্ণা। বিয়ে করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন এক আইনজীবীর। এসবই ঘটছিলো আড়ালে। কথিত রয়েছে বিয়ে করেছিলেন আরেক ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিককেও। যদিও স্বর্ণা এটি স্বীকার করেননি কখনো। সর্বশেষ মাদারীপুরের রাজৈর’র শ্রীকৃষ্ণদি গ্রামের আব্দুল মান্নান মাতব্বরের পুত্র সৌদি প্রবাসী কামরুল হাসানকে বিয়ে করেন তিনি। প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গত ১১ই মার্চ অভিনেত্রী স্বর্ণাসহ আরো ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সৌদি প্রবাসী কামরুল ইসলাম। মামলার পরদিন লালমাটিয়ার বাসা থেকে স্বর্ণা, তার মা শেইলী, ছেলে আন্নাফিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছে।