নন্দীগ্রাম আসনে নিজে হারলেও রাজ্যে বিজেপিকে কার্যত ধূলিসাৎ করে, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ-এর বাংলা দখলের স্বপ্নকে চূর্ণবিচূর্ণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস টানা তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এলো। এ জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি টুইটে লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ে মমতা দিদিকে অভিনন্দন। বাংলা নিজের মেয়েকে চায়- তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটপূর্ব এ স্লোগানকে সফল করতেই যেন গোটা পশ্চিমবঙ্গ তাদের আশীর্বাদ উজাড় করে দিয়েছে মমতাকে। তাই পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে তৃণমূল আবার ক্ষমতায় এলো। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- কে হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের নতুন মুখ্যমন্ত্রী? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে হেরে যাওয়ার পর কি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন? এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৬৩ এবং ১৬৪ ধারাতেই। সে অনুযায়ী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যদি তার দলীয় আইনপ্রণেতারা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেন, তাহলে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কিন্তু এ সময়ের পর থেকে ৬ মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে কোনো একটি আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আসতেই হবে তাকে। যদি তিনি এ সময়ের মধ্যে নির্বাচিত হয়ে আসতে না পারেন, তাহলে আর মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।
তাই ৬ মাস সময়ের মধ্যে তার দলের কোনো আইনপ্রণেতা যদি নিজের আসন ছেড়ে দেন এবং সেই আসনে মমতা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন, তাহলে তিনি অব্যাহতভাবে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন।
বিজেপি আসনের নিরিখে তিন অঙ্কে শুধু উঠতে পারেনি তা-ই নয়, তাদের ভোট শতাংশও কমেছে। একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে কংগ্রেস-সিপিএম-আইএসএফের সংযুক্ত মোর্চা। ভোট শতাংশের হার বলে দিচ্ছে যে, শুধু সংখ্যালঘু ভোট নয়, হিন্দু-পিছলে বর্গ আর বর্ণ হিন্দুদের ভোটও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছেন। ভোটের আগে গত এক বছরে ১৪৮ জন তৃণমূল নেতা দল বদলে বিজেপিতে গিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ২০ শতাংশই জিততে পারেননি। ভারতীয় গণমাধ্যমের হিসাবে, নিজের হাতেগড়া নেতা শুভেন্দু অধিকারী নন্দীগ্রামে প্রায় দুই হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এই পরাজয় মেনে নিয়েছেন মমতা। তবে তিনি এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। গতকাল বিকাল নাগাদ একটি বার্তা সংস্থার তরফে দেয়া রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে খবর প্রকাশ হয় যে, নন্দীগ্রামে বিজয়ী হয়েছেন মমতা। এ খবর সংবাদ শিরোনাম হয় সব মিডিয়ায়। কিন্তু সন্ধ্যার আগে আগে এ খবর নিয়ে দেখা দেয় বিভ্রান্তি, যখন নির্বাচন কমিশন নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীকে বিজয়ী ঘোষণা করে। পরে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের ফল মেনে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এবার নির্বাচনী প্রচারে একুশবার পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অমিত শাহ-জেপি নাড্ডারা বাংলাকে সেকেন্ড হোম বানিয়েছিলেন। কিন্তু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং- এই বাহিনীকে নামিয়েও বিজেপি বাংলার নেত্রীকে সার্বিকভাবে পর্যুদস্ত করতে পারলো না। নন্দীগ্রামে হারলেও জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিকল্প মুখ হিসেবে মমতাকেই বিরোধীরা তুলে ধরলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। এই ভোটে মমতার তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির অভিযোগ ছিল দুর্নীতি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট রাজ এবং মমতার তোষামোদি নীতির। যাকে বলা হয় সংখ্যালঘু তোষণ। কিন্তু রাজ্যের সংখ্যালঘু সমপ্রদায় শুধু যে মমতাকে সমর্থন করেছে তা নয়, মমতা সমর্থন পেয়েছেন সব শ্রেণির। তোলাবাজি, দুর্নীতির অভিযোগ তলিয়ে গেছে বিজেপির বহিরাগত নেতাদের আনাগোনায়। বিজেপিকে বাংলার দল বলে মেনে নিতে পারেনি বাংলার মানুষ। সেই সঙ্গে বিজেপি সম্ভবত বুঝতে পারলো, জাঁকজমকপূর্ণ সভা, হেলিকপ্টার, চার্টার্ড ফ্লাইটের বাইরেও নির্বাচন জিততে চাই একটা সক্রিয় সংগঠন। ভাড়াটে সৈনিক নিয়ে যুদ্ধ করা যায়, যুদ্ধ জেতা যায় না।
নিজে নেতৃত্ব দিয়ে টানা তিনবার দলকে জিতিয়েছেন মমতা। তাতেই হ্যাটট্রিক মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূলের সুপ্রিমো। যেখানে তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকবেন কিনা, তা নিয়েই আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে ভূমিধস জয় দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। স্বাভাবিকভাবেই তার মুখজুড়ে প্রশস্ত হাসি। তবে নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর কাছে হেরে কিছুটা হোঁচট খেয়েছেন তিনি। ভারতের এ সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী, শক্তিধর বিজেপির দাপটকে উড়িয়ে দিয়েছেন মমতা। তাই অভিনন্দন বার্তায় ভাসছেন তিনি। তাকে বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা অভিনন্দন বার্তায় ‘টাইগ্রেস অব বেঙ্গল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর কারণ, মমতাকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎখাতের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল বিজেপি। এক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা, ধর্মীয় রাজনৈতিক মেরুকরণের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সব কিছুকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন মাটির মেয়ে ক্যারিশম্যাটিক মমতা। নির্বাচনের ফল গণনা শুরু হয় গতকাল সকাল থেকেই। স্বাভাবিকভাবেই এদিকে তাকিয়ে ছিল প্রতিবেশী দেশগুলো। কারণ, এখানকার রাজনীতির সঙ্গে আবর্তিত হয় এ অঞ্চলের আন্তঃরাজনীতি। পুরোদিন শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা বিরাজ করে। প্রথমদিকে প্রাপ্ত খবরে বলা হয়, নিজের হাতেগড়া শুভেন্দু অধিকারী (যিনি ডিগবাজি দিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন) এগিয়ে ছিলেন কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে। তার বিপরীতে মমতা পিছিয়ে পড়েন। পুরো রাজ্যের বিজয়ের খবর আসতে থাকলেও মমতার এমন খবরে অনেকেরই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কিন্তু সেই চিন্তার রেখা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে যেতে থাকে। আস্তে আস্তে সেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে ফলাও করে প্রচার করা হয় মমতা বিজয়ী হয়েছেন নন্দীগ্রামে। এরপর রাজ্যের জয় পাকাপোক্ত হওয়ার পর ঘর থেকে বেরিয়ে হেঁটে অফিসে গিয়েছেন মমতা। কিন্তু সন্ধ্যায় মেলে আরেক খবর। এবার নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে নন্দীগ্রামে মমতা নন, জিতেছেন শুভেন্দু অধিকারী। মমতা সেটা মেনে নিয়েছেন। তবে তিনি এ ফলের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে পরে বলা হয়, ভোট পুনঃগণনা হবে। রাত বাড়ার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার জানানো হয়, ভোট পুনঃগণনা হবে না। শুধু এই হেভিওয়েট আসনটি ঘিরে এদিন সবার চোখ ছিল সতর্ক।
গতকাল ভারতের মোট ৫টি রাজ্যের ভোটের ফল গণনা করে ফল ঘোষণা করা হয়। এগুলো হলো- পশ্চিমবঙ্গ, পুদুচেরি, তামিলনাড়ু, কেরালা ও আসাম। এর মধ্যে সবারই দৃষ্টি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। কারণ, অনেক। এই রাজ্যে মোট আসন আছে ২৯৪টি। এর মধ্যে কোনো দলকে সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে কমপক্ষে ১৪৮টি আসন পেতে হয়। সেই হিসেবে ২১৫ আসনে জিতে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস। আর বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৭৫টি আসন। দুটি আসনের দু’জন প্রার্থী মারা যাওয়ায় সেখানে নির্বাচন হয়নি। এমন জয়ে কার না আনন্দ হয়! কিন্তু সেই আনন্দে মিছিল না করার জন্য নেতাকর্মীদের অনুরোধ করেছেন মমতা। বলেছেন, করোনা মহামারিকালে স্বাস্থ্যবিধি মানতে। করোনা মোকাবিলা হবে তার সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে, আসামে মোট ১২৬ আসন। তার মধ্যে ১২২ আসনে নির্বাচন হয়েছে। এতে ৫৬ আসনে এগিয়ে ছিল বিজেপি। দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস। তারা পেয়েছে ২৯ আসন। এখানে সরকার গঠন করতে ৬৪ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হয়। ফলে যদি কোনো দল এই সংখ্যক আসন পেতে ব্যর্থ হয় তাহলে আসামে হতে পারে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট।
তামিলনাড়ুতে মোট আসন ২৩৪টি। এখানে কোনো দলকে সরকার গঠন করতে প্রয়োজন ১১৮ আসন। এর মধ্যে ডিএমকে ১২০ আসন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। ফলে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এআইএডিএমকে। তারা পেয়েছে ৮০টি আসন। আর বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৩টি আসন।
কেরালা রাজ্যে মোট আসন ১৪০টি। সরকার গঠন করতে হলে এখানে কোনো দলকে কমপক্ষে ৭১টি আসনে বিজয়ী হতে হয়। এখানে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআইএম) পেয়েছে ৫৮টি আসন। কংগ্রেস পেয়েছে ২৫ আসন। এই রাজ্যে বিজেপি কোনো আসনই পায়নি।
পুদুচেরিতে বিধানসভার মোট আসন ৩০টি। তবে নির্বাচন হয়েছে ২১টি আসনে। এখানে সরকার গঠন করতে হলে কমপক্ষে ১৬টি আসনে বিজয়ী হতে হয়। কিন্তু এআইএনআরসি জোট ৮ আসন পেয়ে এগিয়ে আছে। এই জোটে রয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে মাত্র ৩টি আসন নিয়ে বিজেপির পিছনে অবস্থান করছে কংগ্রেস।