ভারতে মহামারীর হানা কোথায় গিয়ে থামবে, এখন পর্যন্ত তার সদুত্তর মেলেনি। তবে সংক্রমণের পাশাপাশি যেভাবে মৃত্যু বেড়ে চলেছে, তাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক মহলেও। কারণ এই মুহূর্তে যে হারে দেশটিতে মৃত্যু বেড়ে চলেছে, গোটা বিশ্বের তুলনায় তার ২৫ শতাংশ ঘটছে ভারতে । গত ২৮ এপ্রিলের যে হিসাব পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ওইদিন বিশ্বের সর্বত্র ১২ হাজার ৩০৩ জন করোনা রোগী প্রাণ হারান। এর মধ্যে ভারতেই মারা যান ৩ হাজার ২৯৩ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন বিশ্বে করোনায় যত মৃত্যু ঘটছে, তার প্রতি চারটির মধ্যে একটি ঘটছে ভারতে।
করোনা শনাক্তের তালিকায় এখনো ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। তবে প্রতিদিন দেশটিতে যে হারে রোগী শনাক্ত হচ্ছে, তাতে অচিরেই তারা যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে এক নম্বর অবস্থানে উঠে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগের দিন সকাল থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছে রেকর্ড ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৪৫২ জন। এদিন মারা গেছেন আরও ৩ হাজার ৪৯৮ জন। এ নিয় ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১ কোটি ৮৭ লাখ ৬২ হাজারের বেশি। আর মোট মারা গেছেন ২ লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষ।
এই খারাপ অবস্থার মধ্যেও যে টিকা নিয়ে আশার সঞ্চার হয়েছিল, ভারতবাসীর মধ্যে তা ফিকে হতে শুরু করেছে। জানুয়ারিতে দেশটিতে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলেও এখন পর্যন্ত তারা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশকে টিকার প্রথম ডোজ দিতে পেরেছে। ইতোমধ্যে রাজধানী দিল্লিসহ দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে দেখা দিয়েছে টিকার তীব্র সংকট। যদিও ভারতের সরকার আজ শনিবার থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সব নাগরিককে টিকাদানের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু টিকা সংকটের কারণে এই উদ্যোগ সফল হচ্ছে না।
দেশের প্রাণকেন্দ্র খোদ দিল্লিই হয়ে পড়েছে টিকাশূন্য। ফলে শনিবার থেকে কাউকে টিকার জন্য লাইনে না দাঁড়াতে অনুরোধ করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। টিকা পেলে রাজ্যের সবাইকে যথাসময়ে জানিয়ে দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। টিকার ঘাটতির কারণে মুম্বাই শহরেও সব টিকাদান কেন্দ্র গতকাল থেকে তিনদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কর্নাটকের মতো উচ্চ সংক্রমণ থাকা আরও একাধিক রাজ্য জানিয়েছে, টিকার ঘাটতির কারণে তারা আপাতত ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের টিকা দিতে পারবে না। পরিস্থিতি বিবেচেনায় মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এদিকে আক্রান্ত ও মৃতের দিক দিয়ে রাজধানী দিল্লির পরিস্থিতি আরও বেদনাবহ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন শহরে যে পরিমাণ মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে শ্মশানগুলোয় চিতার আগুন নিভছেই না। কবরস্থানগুলোতেও একই দশা। দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলায় দেখা গিয়েছিল শ্মশানে শৃগাল-কুকুর। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস ফিরে দেখলে, ‘কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে?… অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে।’ রাজধানীর বর্তমান পরিস্থিতি এই রকমই কিনা, সেই প্রশ্ন আজ দগদগে। শ্মশানে জায়গা না পেয়ে বাড়িতে মৃতদেহ ফিরিয়ে এনে পচন আটকাতে বরফচাপা দেওয়াটা দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তে নিত্যনৈমিত্তিক। একাকী যারা মারা গিয়েছেন, তাদের কারও কারও সৎকার হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে। অক্সিজেন নিয়ে হাহাকার অব্যাহত, নিভছে না চিতা। গড়ে প্রতি ঘণ্টায় দশ থেকে পনেরো জন কোভিড রোগীর দাহ হচ্ছে শ্মশানে।
অতিমারীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দিল্লিতে কোভিডে মৃতের সংখ্যা পনেরো হাজারের কিছু বেশি। গত তিন-চার সপ্তাহে শুধু নথিভুক্ত মৃতদেহ ৩ হাজার ৯৮২টি। সূত্রের মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ নথিভুক্ত না করেই অগণিত মৃতদেহ দাহ হয়ে যাচ্ছে। এগারো বছর ধরে দিল্লির দয়ানন্দ মুক্তিধাম শ্মশানে কাজ করছেন রাম পাল। জনে জনে প্রতিটি পরিবারকে বলছেন, এখানে আসবেন না, জায়গা নেই। কিন্তু সে কথায় কাজ হচ্ছে না। রাম পাল বলছেন, এখানে প্রতিদিন ৩০টি দেহ দাহ করা সম্ভব। সেখানে গত পাঁচ দিনে রোজ চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি দাহকার্য করতে হয়েছে। সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, যমুনার তীরে দাহকার্যের ব্যবস্থা করুন। তা হলে অন্তত পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করা যাবে। একটি দেহ দাহ করতে অন্তত ৩০০ কেজি কাঠ লাগে। এত কাঠই বা কে জোগায়?
মৃতদেহের দীর্ঘ সারির মাঝখানে দাঁড়িয়ে অসহায় সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষই। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য আইনজীবী অনীপ সচতে অক্সিজেন না পেয়ে বাড়িতেই মারা যান। তার স্ত্রী এবং কন্যা বেলা ১১টায় শ্মশানে গিয়ে শোনেন, ২৫ জনের পিছনে রয়েছেন তারা। সচতের স্ত্রীর কথায়, আমরা পুরো দিন অপেক্ষা করেছি, বিভিন্ন শ্মশানে ফোন করে গিয়েছি। শেষে দাহকার্য হয় মাঝরাতে। এই শহরে যারা একা রয়েছেন অথবা যাদের সঙ্গীও কোভিডে আক্রান্ত, তাদের পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর। দিল্লির বসন্তকুঞ্জের প্রবীণ বাসিন্দা সংঘমিত্রা সেন মারা গিয়েছেন কোভিডে। তার স্বামীও করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। একমাত্র ছেলে আটকে রয়েছেন বেঙ্গালুরুতে। যুব কংগ্রেস এবং একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় সংঘমিত্রার শেষকৃত্য হয়। একটি চ্যানেলে দেখা গিয়েছে শ্রুতি সাহাকে। মাকে বাঁচাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কারখানায় লাইন দিয়েছিলেন শ্রুতি। সবার হাতে-পায়ে ধরছিলেন, যদি ফাঁকা সিলিন্ডারটা একটু তাড়াতাড়ি ভরে দেওয়া হয়। তাকে বলা হয়েছিল, অপেক্ষা করতে। লাইনেই খবর এলো, মা আর নেই।
চতুর্দিকে যখন শ্মশানের ছাই উড়ছে, সেই সময়েও কিছু মানুষের উদ্যোগে দিল্লিতে এখনো প্রতি সকালে সূর্য উঠছে বলে মনে করছেন বাসিন্দারা। দক্ষিণ দিল্লির গ্রেটার কৈলাসে ‘অক্সিজেন লঙ্গর’ খুলেছে গুরুদ্বার সিংহ সভা। তারা নিজ উদ্যোগে খালি সিলিন্ডার ভরে দিচ্ছে। দিল্লি গুরুদ্বার কমিটির প্রাক্তন সভাপতি মনজিৎ সিংহ জানাচ্ছেন, তারা পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা থেকে অক্সিজেন জোগাড় করছেন দিল্লিবাসীর জন্য। তিনি বলছেন, যদি আরও জোগাড় করতে পারি, চব্বিশ ঘণ্টাই এই লঙ্গর চালু থাকবে। অক্সিজেনের পাশাপাশি কোভিড আক্রান্তদের জন্য বিনামূল্যে খাবারও পাঠাচ্ছে এই গুরুদ্বার।