ঢাকা: নিয়ম ভেঙে কেজি মাপে তরমুজ বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। অথচ যে পদ্ধতিতে ক্রয় সেই নিয়মেই পণ্য বিক্রির বিধান রয়েছে ভোক্তা অধিকার আইনে। কৃষক থেকে পাইকাররা পিস হিসাবে তরমুজ কেনেন।
কিন্তু বেশি লাভের আশায় খুচরা বাজারে অন্যায়ভাবে সেই তরমুজ কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে সাধারণ ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে গেছে মৌসুমি এই ফলটি। ৮-১০ কেজি ওজনের একটি তরমুজ বর্তমানে বিক্রি করা হচ্ছে ৪ থেকে ৫শ টাকায়। পাইকারি বাজারে এই সাইজের তরমুজের দাম সর্বোচ্চ ২শ থেকে ২১০ টাকা। উৎপাদক পর্যায়ে গেলে তা আরও কম। পুরো বিষয়টিকেই খুচরা বিক্রেতাদের কারসাজি বলছেন পাইকার আর তরমুজ চাষিরা। এ বছরই প্রথম এই পদ্ধতিতে তরমুজ বিক্রি চলছে সারা দেশে। কী করে এই সিন্ডিকেট তৈরি হলো তারও কোনো উত্তর মিলছে না। মাঝখান থেকে দেশেই উৎপাদিত এই সুমিষ্ট ফলটির স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
দেশে পিস হিসাবেই কেনাবেচা হতো তরমুজ। উৎপাদক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত ছিল একই পদ্ধতি। কৃষক যেমন পাইকারদের কাছে পিস হিসাবে বিক্রি করত, তেমনি পাইকারও খুচরা বিক্রেতার হাতে একই পদ্ধতিতে তুলে দিত। খুচরা বিক্রেতারাও পিস হিসাবেই বিক্রি করত সাধারণ ক্রেতার কাছে। এ বছর কৃষক থেকে পাইকার পর্যন্ত এই পদ্ধতি বহাল থাকলেও গোল বাঁধিয়েছে খুচরা বিক্রেতারা। কেজি দরে তরমুজ বিক্রি করছে তারা। এই দৃশ্য এখন সারা দেশে। ফলে উৎপাদক পর্যায়ে মাত্র ৮০/১০০ টাকায় বিক্রি হওয়া তরমুজের দাম খুচরা বাজারে এসে হয়ে যাচ্ছে ২শ থেকে আড়াইশ টাকা।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, দেশে উৎপাদিত মোট তরমুজের শতকরা ৬৪ ভাগই উৎপাদন করে বরিশাল অঞ্চলের চাষিরা। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর এবং বরিশালে তরমুজের উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তরমুজ উৎপাদন হলেও সমুদ্র তীরবর্তী নোনা পানির এলাকা হওয়ায় বরিশাল অঞ্চলে উৎপাদিত তরমুজের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কেননা এই অঞ্চলের তরমুজ অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি মিষ্টি। উৎপাদনে প্রথম সারিতে থাকা পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার বেশ কয়েকজন তরমুজ চাষির সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও ক্ষেত কিংবা সংখ্যার হিসাবে পাইকারদের কাছে তরমুজ বিক্রি করেছেন তারা। এক্ষেত্রে ৪ থেকে ৫ কেজি ওজনের একেকটি তরমুজের দাম পড়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা।
গলাচিপা উপজেলার চরবিশ্বাস ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হাসান সরদার বলেন, ‘মূলত দুই পদ্ধতিতে তরমুজ বিক্রি করি আমরা। একটি হলো পাইকাররা সরাসরি আমাদের কাছে এসে তরমুজ কিনে নিয়ে যায় অথবা আমরা তরমুজ নিয়ে শহরের আড়তে যাই। সেখানে যে দামে তরমুজ বিক্রি হয় তার শতকরা ৫ টাকা আড়তদারকে দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে আসি।’
একই ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নেছার সরদার বলেন, ‘আমি ১৩ একর জমিতে এবার তরমুজ করেছি। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও শর্ত হিসাবে তরমুজ বিক্রি করেছি পাইকারের কাছে। ৪ থেকে ৫ কেজি ওজনের একশ’ তরমুজের দাম পেয়েছি ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। এর চেয়ে বড় অর্থাৎ ৮-১০ কেজি ওজনের তরমুজ ক্ষেত থেকে বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায়।’ হাসান এবং নেছার সরদারের দেওয়া তথ্যেই উৎপাদক পর্যায় থেকে তরমুজ বিক্রি হওয়ার তথ্য মিলেছে দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলা উপজেলায়। এই দরের সঙ্গে মোটামুটি মিল রয়েছে পাইকারি বাজারেও। বরিশাল নগরের দক্ষিণ পোর্ট রোডের পাইকার দত্ত বাণিজ্যালয়ের মালিক গণেশ দত্ত বলেন, ‘সরাসরি ক্ষেত থেকে মাঝারি সাইজের একটি তরমুজ ৬০-৭০ টাকায় কেনার পর আড়তে এনে বিক্রি পর্যন্ত খরচ মিলিয়ে আমরা প্রতি পিস গড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকা রাখি। সাধারণত ৪-৫ কেজি ওজনের তরমুজকেই মাঝারি সাইজ বলে ধরা হয়। এছাড়া ৮-১০ কেজি কিংবা তারও বেশি ওজনের তরমুজ পাইকারি হিসাবে প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়।’
আপনাদের কাছ থেকে পিস হিসাবে কিনে খুচরা বিক্রেতারা কেজি দরে কেন বিক্রি করছেÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা কী বলব বলুন? খুচরা বিক্রেতারা তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে না। তবে এটা বলতে পারি যে এটি নিয়মবিরুদ্ধ। আমার কাছ থেকে ১০০ টাকায় কিনে সর্বোচ্চ ১২০/৩০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন একজন খুচরা বিক্রেতা। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’
বরিশাল তথা দক্ষিণের প্রায় সব এলাকা থেকে পাওয়া গেছে কেজি দরে তরমুজ বিক্রির অভিযোগ। এমনকি সারা দেশেই হঠাৎ করে ভোক্তা পর্যায়ে কেজি মাপে তরমুজ বিক্রি শুরু করেছেন খুচরা বিক্রেতারা। বিষয়টি সম্পর্কে আলাপকালে বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব
ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘দুর্নীতি খুব দ্রুত গতিতে ছড়ায়। হয়তো বরিশালেই প্রথম এভাবে কেজি দরে তরমুজ বিক্রি শুরু হয়েছে। এই খবর যেমন ছড়িয়ে পড়তে বেশিী সময় লাগেনি; তেমনি বেশি লাভের আশায় সারা দেশের খুচরা বিক্রেতারও সুযোগটি লুফে নিয়েছে।’ নগরের সাগরদি এলাকায় মঙ্গলবার সকালে এক খুচরা বিক্রেতাকে দেখা গেছে মাঝারি সাইজের তরমুজ ৫০ এবং বড় সাইজের তরমুজ ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে। পাইকারি বাজারে যেখানে পিস হিসাবে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে সেখানে কেজি দরে কেন বিক্রি করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো একা না, সবাই বিক্রি করছে। তাছাড়া আড়ত থেকে তরমুজ কিনে দোকানে এনে বিক্রি করার একটা খরচ আছে না?’ পোর্ট রোডের আড়ত থেকে কিনে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরের সাগরদি বাজারে এনে বিক্রি করার ক্ষেত্রে তরমুজ প্রতি ২-৩ টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা না, সেখানে কেজিতে বিক্রি করলে দাম কী করে দেড়-দু’শ টাকা বেড়ে যায়Ñএই প্রশ্নের অবশ্য কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি এই বিক্রেতা। কেবল এই একজনই নন, বরিশাল নগরীতে থাকা সবগুলো বাজারেই কেজি দরে তরমুজ বিক্রি করতে দেখা গেছে খুচরা বিক্রেতাদের। বিষয়টি নিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে ক্রেতাদের ঝগড়া তর্কাতর্কিও হতে দেওয়া গেছে বিভিন্ন জায়গায়।
বাংলাবাজার এলাকায় তরমুজ কিনতে আসা ওষুধ কোম্পানির চাকুরে ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘গেল বছরও ৮-১০ কেজি ওজনের একটি তরমুজ কিনেছি দেড় থেকে দু’শ টাকায়। এবার দাম চাইছে ৫০০ টাকা। তাও আবার ৫০ টাকা কেজি দরে।’ আরেক ক্রেতা বলেন, ‘কেজি দরে তরমুজ বিক্রি জীবনে এই প্রথম দেখছি।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিক্রির পদ্ধতি সম্পর্কে আইনে কিছু বলা না থাকলেও পাইকারি দরের চেয়ে খুচরা বাজারের দরে কতটা পার্থক্য থাকতে পারে তা স্পষ্ট বলা আছে। তরমুজের ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে সেটা পুরোপুরি বেআইনি। দামের এতটা পার্থক্য করে পণ্য বিক্রির কোনো বিধান ভোক্তা অধিকার আইনে নেই।’
বরিশালের জেলা প্রশাসন জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছি। অতিরিক্ত দামে তরমুজ বিক্রির অপরাধে সোমবার বরিশালের বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে জরিমানা করা হয়েছে। অভিযান পরিচালনাকালে এমনও দেখা গেছে যে পাইকারি বাজার থেকে ৪৪০ টাকায় কেনা তরমুজ ১ হাজার ৪০ টাকা চাওয়া হয়েছে ক্রেতার কাছে। পাইকারি বাজার থেকে যে দামে কিনবে তার চেয়ে পিস কিংবা কেজিপ্রতি ৩-৫ টাকার বেশি নেওয়ার অধিকার তার নেই। এই বিষয়টির দিকেই নজর দিচ্ছি আমরা। দাম নিয়ন্ত্রণে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’