চট্টগ্রামভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামে বিরাজ করছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক। গত ১৪ দিনে সংগঠনটির ১৫ শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তারকৃতদের ইতিমধ্যে ২০১৩ সালের ৫ই এবং গত ২৬ই মার্চের ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়াও আরও ১৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা নজরদারিতে আছেন। এই ১৫ জন হেফাজতের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে মাঠ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরমধ্যে একজন নেতাকে ধরতে ডিবি বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালালেও তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় হেফাজতের সহকারী সেক্রেটারি। তিনি মামুনুলের ঘনিষ্ঠ সহচর।
গ্রেপ্তার এড়াতে কোন কোন নেতা গাঢাকা দিয়েছেন। কেউ গেছেন আত্মগোপনে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, তারা পুলিশের নজরদারিতেই আছেন। তারা যাতে কেউ দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে। এজন্য স্থল ও আকাশপথের ইমিগ্রেশন পুলিশকে অবগত করা হয়েছে। কয়েকদিন আগে হেফাজতের নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাসায় একটি বৈঠক করেন। কিন্তু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, সহিংসতার মামলায় যাদের নাম আছে তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (মিডিয়া) মোহাম্মদ হায়দার আলী খান মানবজমিনকে জানান, ‘মামলায় যারা সুনির্দিষ্ট আসামি তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। সহিংসতা এবং সন্ত্রাসে যারাই জড়িত হবে তাদের সকলকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’ হেফাজত যদি আবার মাঠে নামে তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী-হবে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। সমাজে কেউ বিশৃঙ্খলা করে রক্ষা পাবে না।’
পুলিশ সদর দপ্তর ও র্যাব সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ই এপ্রিল হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এবং মুখপাত্র মো. আজিজুল ইসলামাবাদীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর ডিবি। তাকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসস্ট্যান্ড থেকে ডিবির একটি টিম গ্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে আসে। তাকে গ্রেপ্তার করার পরই হেফাজতে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গত ২২শে এপ্রিল বংশাল এলাকা থেকে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর সহ-দপ্তর সম্পাদক ও ইসলামী ছাত্র সমাজের সাধারণ সম্পাদক ইহতেশামুল হক সাখীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গত ১৬ই এপ্রিল হেফাজতের ঢাকা মহানগর সহ-সভাপতি মাওলানা জুবায়ের আহমদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। তাকে ২০১৩ সালের একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ১৩ই এপ্রিল কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর তারবিয়াতুল উম্মাহ মাদ্রাসা থেকে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর সহ-সভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গত ১৩ই এপ্রিল ঢাকার হাজারিবাগ এলাকা থেকে হেফাজতের সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরীফ উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।
সূত্র জানায়, গত ১৫ই এপ্রিল রাজধানীর গ্রীন রোড এলাকা থেকে হেফাজতে ইসলাম কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আফেন্দি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহকারী মহাসচিবের দায়িত্বেও রয়েছেন। গত ১৪ই এপ্রিল রাজধানীর লালবাগ এলাকা থেকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গত ১৭ই এপ্রিল সংগঠনটির ঢাকা মহানগরের আমীর জুনায়েদ আল হাবিবকে ঢাকার বারিধারা মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। জুনায়েদ আল হাবিবের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৫ই মে ঢাকার শাপলা চত্বরে সহিংসতার ঘটনায় মামলা ছাড়াও একাধিক অভিযোগে মামলা রয়েছে। গত ১৭ই এপ্রিল রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সংগঠনির কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গত ১৮ই এপ্রিল মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসা থেকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়াও গত ১৬ই এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফাজত সেক্রেটারি মুফতি বশির উল্লাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তাছাড়া গত ২৪শে এপ্রিল রাজধানীর আগারগাঁও থেকে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর ড. আহমেদ আব্দুল কাদেরকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। সকল নেতাকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬শে মার্চ মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সিগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলায় পুলিশের সঙ্গে হেফাজতের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তাতে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে একাধিক মামলা দায়ের হয়। সেই মামলাগুলোতে হেফাজতের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। মামলা হওয়ার পর তাদের গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। উচ্চ মহলের গ্রীন সিগন্যালের পর তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, মাঠ পর্যায়ের হেফাজতকে নেতৃত্বদানকারী ৩০ জনের তালিকা তৈরি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতিমধ্যে ১৫ জনকে আটক করে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ এবং নোয়াখালী জেলার একাধিক নেতাকে আইনের আওতায় আনা হতে পারে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে হেফাজতের আমীরকে গ্রেপ্তার করা হবে কী-না এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তাকে মাদ্রাসায় গৃহবন্দি রাখা হতে পারে বলে পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। হেফাজতের ১৫ নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতের সাংগঠনিক অবস্থা এখন মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করছে। ইতিমধ্যে তারা একটি প্রতিবেদন পুলিশ সদর দপ্তরে জমা দিয়েছেন।