করোনার টিকার প্রথম ডোজ দেয়ার কর্মসূচি আজ থেকে বন্ধ। টিকার স্বল্পতার কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে প্রাপ্ত টিকা থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮১ লাখ ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। হাতে আছে মাত্র সাড়ে ২০ লাখ ডোজ। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসার কথা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, গত তিন মাসে এসেছে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ। ভারত থেকে মার্চ মাসে কোনো টিকা আসেনি। এ হিসাবে মার্চ পর্যন্তই ৮০ লাখ ডোজ টিকা কম পেয়েছে বাংলাদেশ।
আর এপ্রিলের টিকা আসবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়।
এরমধ্যে শনিবার ভারতীয় হাইকমিশনের তরফ থেকে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে বলা হয়, তাদের পক্ষে টিকা সরবরাহ করা সম্ভব নয়। চিঠিতে দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ভারতেই টিকার চাহিদা বেশি। তাছাড়া, কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এই অবস্থায় ভারতের পক্ষে টিকা সরবরাহ করা সম্ভব নয়। ভারতের এই সিদ্ধান্ত জানার পরই দেশে টিকার প্রথম ডোজ কর্মসূচি বন্ধ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম রোববার সাংবাদিকদের জানান, তারা আশা করছেন মে মাসের প্রথমদিকে ২০ লাখ ডোজ টিকা সেরাম ইনস্টিটিউট সরবরাহ করবে। তিনি এও জানান, মে মাসে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে ফাইজার থেকে ১ লাখ টিকা পাওয়া যাবে।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, আজ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত করোনার প্রথম ডোজ টিকা দেয়া বন্ধ থাকবে দেশে। কি কারণে প্রথম ডোজের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে তার কারণ চিঠিতে উল্লেখ না থাকলেও সূত্র বলছে, টিকার স্বল্পতার কারণেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ডের টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে গত বছরের ৫ই নভেম্বর সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়। ওই টিকার প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ দেশে আসে গত ২৫শে জানুয়ারি। এর আগে ভারত সরকার বাংলাদেশকে আরো ২০ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পাঠায় ২১শে জানুয়ারি। ওই টিকা হাতে পাওয়ার পর ২৭ ও ২৮শে জানুয়ারি পরীক্ষামূলক টিকাদান করা হয়। ৭ই ফেব্রুয়ারি সারা দেশে গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ২২শে ফেব্রুয়ারি কেনা টিকার আরো ২০ লাখ ডোজ আসে। আর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশকে আরো ১২ লাখ ডোজ টিকা উপহার দেয় ভারত। সব মিলিয়ে সরকার এক কোটি দুই লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, কেনা টিকার তিন কোটি ডোজের মধ্যে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে আসার কথা। কিন্তু জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে আসে ২০ লাখ ডোজ। ৩০ লাখ ডোজ কম আসে। মার্চ মাসে কোনো টিকা আসেনি। এ হিসাবে মার্চ পর্যন্তই চুক্তি অনুযায়ী ৮০ লাখ ডোজ টিকা কম পেয়েছে বাংলাদেশ। আর এপ্রিলের টিকা আসবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের কার্যক্রম একইসঙ্গে চালানোটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিতীয় ডোজগুলো দেয়া যাবে কিনা, এ বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। কারণ এই মুহূর্তে মজুত কমে আসছে।
ভারতীয় হাইকমিশনের চিঠি: অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করলেও সহসা সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন পাচ্ছে না বাংলাদেশ। টিকা নিয়ে শনিবার ভারতীয় হাইকমিশন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়েছে। এতে সহসা টিকা পাওয়ার কোনো আভাস দেয়া হয়নি। বরং এতে বলা হয়েছে, কাঁচামালের সংকট ও ভারতে বিপুল অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে ভ্যাকসিন সরবরাহে দেরি হচ্ছে। ভারত তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছে। পাশাপাশি পুনের সেরাম ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাকসিন সরবরাহের যেসব চুক্তি করেছিল, সেই অনুযায়ী ভ্যাকসিন উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। ভ্যাকসিনের কাঁচামাল রপ্তানিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়েও ইঙ্গিত করা হয় চিঠিতে। বলা হয়, প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলো কাঁচামাল আটকে দিয়েছে, এ বিষয়টিও সবার জানা। এতে বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরামের ওপর প্রভাব পড়েছে।
চিঠিতে ভারত বায়োটেকের ‘কোভ্যাক্সিন’ যৌথ উৎপাদনের বিষয়ে বলা হয়, আইসিডিডিআর,বি’ এবং ভারত বায়োটেক ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কোভ্যাক্সিনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য চুক্তি করেছিল। তবে, সেটা এখনো বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। কোভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা কোভিশিল্ডের চেয়ে বেশি উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, আমাদের বর্ধিত সক্ষমতা ও একাধিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ যদি কোভ্যাক্সিন যৌথভাবে উৎপাদন শুরু করে তবে বাংলাদেশে তৈরি ভ্যাকসিন ভারতসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোতে সরবরাহ করা হবে। সেই সুযোগটি এখনো হারিয়ে যায়নি। আমরা এর সদ্ব্যবহার করতে পারি।
স্বাস্থ্যের ডিজি টিকা নিয়ে যা বললেন: আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনাভাইরাসের প্রায় ২১ লাখ টিকা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, এর একটি অংশ আনবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। আরেকটি পাওয়া যাবে কোভ্যাক্স থেকে।
গতকাল বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস উপলক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আয়োজিত এক আলোচনা সভার পরে মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, বেক্সিমকো আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ টিকা দিচ্ছে। এ ছাড়া কোভ্যাক্স থেকে ফাইজারের উৎপাদিত ১ লাখ টিকা পাওয়া যাবে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা পাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে মহাপরিচালক বলেন, গত পরশু বেক্সিমকো ২০ লাখ ডোজ টিকার কথা জানিয়েছে। দেশে ভারতের ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি আছে কিনা এমন কোনো নিশ্চিত খবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই বলে জানান সংস্থাটির মহাপরিচালক। তবে দেশে নাইজেরিয়ার ভ্যারিয়েন্ট পাওয়ার কথা তিনি গণমাধ্যমেই জেনেছেন। ডিজি বলেন, আর কোনো বিপর্যয় এড়াতে এখন ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ রাখা উচিত। এ বিষয়ে আমাদের মতামত আমরা যথাযথ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। যদিও সরকারের উপরের মহল থেকেই এ সিদ্ধান্ত আসবে।
টিকা বিতরণ ৮১ লাখ ৪৫ হাজার ডোজ: দেশে ১৪তম দিনে টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ৭১ হাজার ৫৭০ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে নিয়েছেন ২৭ হাজার ৮২৯ জন। এ পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ২৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৬ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় মিলে টিকা দেয়া হয়েছে ৮১ লাখ ৪৫ হাজার ২৬৬ ডোজ। বিতরণ করা টিকা বাদ দিলে হাতে মজুত আছে মাত্র ২০ লাখ ৫৪ হাজার ৭৩৪ ডোজ। অন্যদিকে সারা দেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরুর ৬৩তম দিনে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন ১৯ হাজার ৫২০ জন। এর মধ্যে ঢাকায় নিয়েছেন ৪ হাজার ৮৪ জন। এ পর্যন্ত দেশে মোট প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ৫৮ লাখ ১৮ হাজার ৪০০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৬ লাখ ৮ হাজার ৫৯ জন এবং নারী ২২ লাখ ১০ হাজার ৩৪১ জন। টিকা নেয়ার পর সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে মোট ৯৯৫ জনের। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টিকা নিতে অনলাইনে মোট নিবন্ধন করেছেন ৭২ লাখ ২৪ হাজার ৩০৭ জন। প্রসঙ্গত, গত ২৭শে জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে গণটিকাদান শুরু হয় ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে। আর দ্বিতীয় ডোজ শুরু হয় ৮ই এপ্রিল থেকে। দেশে কেনা এবং উপহার পাওয়া মিলে এ পর্যন্ত টিকা এসেছে এক কোটি দুই লাখ ডোজ।