শেরপুর থেকে বাসে ঢাকার মহাখালীতে এসেছে রিনা বেগম ও আবু সাঈদ পাগলা দম্পতি। যাবেন কুমিল্লার বেলতলী, ল্যাংটা বাবার উরস শরীফে। সঙ্গে ছেলের ঘরের দুই নাতনি এক নাতি। ওদের বয়স ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। রিনা বেগম বলেন, মহাখালী নামার পর আমরা জানতে পারি সারাদেশে লকডাউন শুরু হয়েছে। বাস-গাড়ি চলবে না। উরসে যোগ দেওয়া দূরে থাক, বাড়িতে পর্যন্ত ফেরা যাবে না। অগত্যা সারাদিন উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটির পর মাজারপাগল এ দম্পতি ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে যে ফ্লাইওভার রয়েছে, সেটির নিচে ঠাঁই নেয়। লকডাউনের এতগুলো দিন ধরে এখানেই নাতি-নাতনিসহ বাস করছেন তারা। এরই মধ্যে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে নামা কালবৈশাখী বয়ে গেছে তাদের মাথার ওপর দিয়ে, বয়ে গেছে রাস্তার ধুলাবালির ঝড়। দিনে গা পোড়ানো প্রখর রোদ আর রাতে অগুনতি মশার উৎপাতও চলছে। এ কয়দিনেই এসব সয়ে গেছে তাদের। অচেনা পরিবেশে আয়হীন, অর্থহীন এ পরিবারটি তবু বেঁচে আছে খেয়ে না-খেয়ে। পাশ দিয়ে লোকজন হেঁটে যেতে দেখলেই ছোট্ট নাতি-নাতনিরা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ত্রাণদাতা ভেবে। তাদের দাদা আবু সাঈদ অনন্যোপায় হয়ে ইতোমধ্যেই নেমে পড়েছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে।
রিনা বেগম আমাদের সময়কে বলেন, বাসের লোকজন তাদের বলেনি যে লকডাউন শুরু হবে। তারাও জানতেন না। শিশু নাতি-নাতনিদের মাজার-ভক্ত বানাতে তাদেরও ঢাকায় এনে আটকাপড়ে গেছেন। মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। এ কারণে বাড়ি থেকে টাকাও আনতে পারেন না। স্বামীর ভিক্ষা থেকে সারাদিনে ১০০-১৫০ টাকা আসে। চাল-চুলোহীন এ অবস্থায় রান্নার উপায় নেই। তাই এ টাকাতেই হোটেল থেকে খাবার কিনে আনেন পাঁচজনের জন্য। ফ্লাইওভারের নিচে তাদের আপাত বসতিতে দেখা গেল সংসারের উপকরণ বলতে আছে সংগ্রহ করা কয়েকটি পানির বোতল।
গতকাল শনিবার বিকালে রিনার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখনও তিন নাতি-নাতনির দুপুরের আহার হয়নি। তাদের দেখিয়ে রিনা বেগম বলেন, মানুষ ভিক্ষাও দেয় না। মানুষের কেন জানি দয়া-মায়া নাই। করোনার কারণে তাদের হাতেও টাকা-পয়সা নাই। পথঘাট দিয়ে মানুষ যখন হেঁটে যায়, হাত পাতি। কেউ সাহায্য করে না। সন্ধ্যার সময় দু-একজন ইফতারির প্যাকেট দিয়ে যায়। তাতে রাতের একবেলা সবাই ভাগ করে খাই।
রিনাদের পুরো পরিবার পাগলা মাজার বা খাজা বাবার ভক্ত হওয়ায় গর্বের সঙ্গে স্বামীর নামের সঙ্গে জুড়ে দেন পাগলা শব্দটি। দুই ছেলে এবং এক মেয়ে তাদের ঘরে। ছেলেরা গ্রামে ঘুরে গ্যাসলাইট বিক্রি, ছাতা-তালার কাজ করেন। কিছু টাকা জমিয়ে ছেলেদের ঘরের নাতি সম্রাট (১০), নাতনি শ্রাবন্তী (৯) ও বাসন্তীকে (৮) নিয়ে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা দেন। ফিরে যাওয়ার টাকা ফুরিয়ে গেছে সেই কবেই।
আটকেপড়ার এতগুলো দিনে প্রতিভোরে নাতি-নাতনিদের হাত ধরে কারওয়ানবাজার মাছবাজারে যান রিনা বেগম। সেখান থেকে ফেলে দেওয়া রূপচাঁদা, পুঁটিসহ সাগরের ছোট বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করেন। আর সেগুলো কেটে শুকাতে দেন ফ্লাইওভারের নিচে।
৭০ বছর বয়সী এই নারী বলেন, আটকেপড়ার পরদিন ভোরবেলা দেখি মানুষ খুব ভোরে পাতিল-ঝুড়ি নিয়ে ওইদিকে (কারওয়ানবাজার) যাচ্ছে। তাদের কাছে জানতে পারি ওখানে বড় মাছের বাজার। এক বেলা কুড়িয়ে তোলা মাছ কয়েক বেলা খাওয়া যাবে। সেভাবেই কারওয়ানবাজার গিয়ে ফেলে দেওয়া মাছ টোকাই; আবার চেয়েও নিই। এখন এগুলো আঁশ ফেলে, শুকিয়ে সময় কাটাচ্ছি। লকডাউন গেলে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাব।