চট্টগ্রাম: মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে অনেকটাই বদলে গেছে করোনা ভাইরাসের ধরন। এখন অনেকে আক্রান্ত হলেও আগের মতো জ্বর, সর্দি-কাশি বা শ্বাসকষ্টের মতো কোনো লক্ষণই থাকছে না। কখনো সামান্য শরীর ব্যথা করলেও ভেতরে ভেতরে ফুসফুসের ৭০ ভাগ নষ্ট করে ফেলছে ভাইরাসটি। এক পর্যায়ে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরীক্ষা করলে ফল আসছে পজিটিভ। আর কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছেন এসব রোগী। এভাবে মারা যাওয়া বেশিরভাগ রোগীই পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী। নির্দিষ্ট কোনো উপসর্গ না থাকায় এ ভাইরাস চিহ্নিত করাটা বেশ সমস্যার বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা ভাইরাস ফুসফুসে দ্রুত সংক্রমণ ঘটিয়ে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় সেটি পুরনো কথা। নিউমোনিয়া রোগের অন্যতম কারণ ফুসফুসে স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। কিন্তু করোনা ভাইরাসের বিস্তার এবং সংক্রমিত হওয়ার গতি স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনির তুলনায় বহুগুণ। কারণ করোনা স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় অনেক আগ্রাসী ও ক্ষতিকর।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জেলায় আগের দিন দুপুর থেকে গতকাল বুধবার দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫ জনসহ মোট মৃত্যুর সংখ্যা ঠেকেছে ৪৭৭ জনে। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনেই মারা গেছেন ৮২ জন। অথচ গত বছরের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে গত ১২ মাসে করোনায় মারা গিয়েছিলেন ৩৯০ জন। এখন মোট আক্রান্ত ৪৭ হাজার ৮৬১ জন।
চলতি মাসে মারা যাওয়া রোগীদের অধিকাংশের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া করোনার নতুন ধরনটি ভয়াবহ। চলতি মাসে তারা অন্তত ৮ জন করোনা রোগী পেয়েছেন যাদের কোনো লক্ষণই ছিল না। হালকা শরীর ব্যথা ছাড়া জ্বরসহ অন্যান্য কোনো উপসর্গ ছিল না। হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি থেকে এই ব্যক্তিরা সন্দেহবশত পরীক্ষা করার পর তাদের রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এর পর দ্রুতই শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি হলে যখন পরীক্ষা করা হয় তখন দেখা যায় তাদের ফুসফুস ৭০ ভাগ অকেজো। তখন চিকিৎসকদের আর করার কিছুই থাকে না।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আবদুর রব আমাদের সময়কে বলেন, ‘এখন বয়স্কদের সঙ্গে কম বয়সীরাও আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের শরীরে ভাইরাসের প্রবেশ ঘটলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ার জন্য করোনা তাদের হয়তো কাবু করতে পারছে না। কিন্তু ভাইরাস দেহে বাসা বেঁধে থাকছে। লক্ষণহীন ওই ব্যক্তি যখন সমাজের অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন, তখন তাদের শরীরেও করোনার সংক্রমণ ঘটে যাচ্ছে। এর মধ্যে যারা দুর্বল অথবা বয়স্ক তারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’
সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০-৬০ বছরের ঊর্ধ্বে রোগী শনাক্ত হচ্ছে ৪৭.২৫ শতাংশ। শিশু-কিশোর আক্রান্ত হচ্ছে ১০.৬১ শতাংশ। আর নতুন উপসর্গহীন করোনায় পঞ্চাশোর্ধ্বরা বেশি মারা যাচ্ছেন। রোগের লক্ষণ না থাকায় তারা পরিবারের অন্যদেরও সংক্রমিত করছেন। এ অবস্থায় সতর্ক থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, এখন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি আইসোলেশনে থাকছেন না। ফলে সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। একজন থেকে পরিবারের একাধিক সদস্য আক্রান্ত হচ্ছেন। কর্মঠ মানুষজনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো। কিন্তু যারা কর্মঠ নন বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা দ্রুত আক্রান্ত হচ্ছেন। কারো মধ্যে শরীর ব্যথা, জ্বরসহ হালকা কোনো লক্ষণ দেখা দিলেই পরীক্ষা ও আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেন তিনি।