সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোমবারের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন থেকে বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পরিবারও এমন সুবিধা পাবেন।
কিন্তু বেসরকারি খাতের কর্মীদের অবস্থাটা কী? তারা কী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন? বেশিরভাগই কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। গার্মেন্টস শ্রমিকদের করোনা আক্রান্ত হলে চাকরি থেকেই বের করে দেয়া হচ্ছে-এমন অভিযোগ করেছেন শ্রমিক নেতারা। আর সাংবাদিকরা সুবিধা তো পাচ্ছেনই না উল্টা প্রতিষ্ঠান থেকে আগের পাওনাও দিচ্ছে না।
শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট ড. উত্তম কুমার দাস বলেন, সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সরকারি বিধি অনুযায়ী সুযোগ সুবিধা নির্ধারিত হয়। বেসরকারি শিল্প কলকারখানা বা প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন, বিশেষত যারা শ্রমিক সংজ্ঞার আওতাভুক্ত তাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর বিধান প্রযোজ্য হবে। আর যারা শ্রমিক সংজ্ঞায় পড়বে না তাদের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিধিমালা প্রযোজ্য। শ্রম আইনের ১৯ ধারায় একটা সুনির্দিষ্ট বিধান আছে। সেখানে বলা হয়েছে, মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ। তবে সেখানে একটা শর্ত আছে সেটা হলো, মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দুই বছর কাজ করতে হবে। এখানে ক্ষতিপূরণের দুই ধরনের ব্যবস্থা আছে। চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি যদি মারা যান তাহলে প্রত্যেক চাকরিরত বছরের জন্য ৩০ দিন হিসেবে এবং কর্মকালীন দুর্ঘটনা হলে পূর্ণবছরের জন্য ৪৫ দিন হিসেবে ক্ষতিপূরণ পাবেন। এখন কোনো প্রতিষ্ঠান যদি খোলা থাকে এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাউকে অফিসে যাওয়া আসা করতে সময়ে যদি কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তাহলে আইনের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করা যায় তিনি কর্মকালীন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এতে তার উত্তরাধিকার একসাথে দুই লাখ টাকা এবং তিনি স্বাভাবিকভাবে অবসরে গেলে যে পাওনাদি হতো এর ভিত্তিতে তিনি চাকরিজনিত আরেকটা সুবিধা পাবেন। যেটাকে আমরা অর্জিত সুবিধা বলি, সেটা পাবেন। এখন প্রশ্ন হলো করোন পেশাগত রোগ কি-না? করোনাকে এখনো পেশাগত রোগের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। তবে ২০২০ সালের সংক্রামক ব্যাধি সংক্রান্ত আইনের যে সংশোধন হয়েছে সেখানে কিন্তু করোনাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ওই হিসেবে শ্রম আইনে এখন সংশোধন বা সমন্বয় করার সুযোগ আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণ হিসেবে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পাবে ব্যাংক কর্মকর্তার পরিবার। কর্মচারী মারা গেলে পাবে ২৫ লাখ টাকা। আর ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার থেকে অফিসারের নিচের পদমর্যাদার কর্মকর্তার পরিবার পাবে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০২০ সালের ২৯ মার্চ থেকে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের সবার পরিবার এ ক্ষতিপূরণ পাবে। তবে গত বছরের ১৫ এপ্রিল এক নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিলো সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হলে ব্যাংক কর্মকর্তা পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পাবেন। আর মারা গেলে এর পাঁচগুণ বেশি ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। নতুন নির্দেশনায় আগের ওই নির্দেশনা বাতিল করা হয়েছে। ফলে ব্যাংক কর্মকর্তা এখন আর ক্ষতিপূরণ পাবেন না। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা শুরু থেকেই এই সুযোগ পাচ্ছিলেন।
মোবাইলে আর্থিক সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির আহমেদ মিশুক বলেন, ‘করোনার জন্য পৃথক নামে নয়, আমাদের এখানে কোনো কর্মী মারা গেলে তার পরিবার বেতনের ১০ গুণ অর্থ পেয়ে থাকেন। গত বছরও একজন কর্মী মারা গেছেন। তার পরিবারকে ৩৩ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নগদের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই চিকিৎসা সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। সেটা এমডি থেকে শুরু করে পিওন পর্যন্ত সবার জন্যই একই নিয়ম। একজন আট হাজার টাকা বেতনের কর্মচারীও অসুস্থ হলে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা পান।
মোবাইল অপারেটর রবির হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স সাহেদ আলমও একই ধরনের উদ্যোগের কথা জানালেন। তিনি বলেন, ‘করোনা নাম দিয়ে হয়তো সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের কর্মীদের ইন্সুরেন্স সুবিধা আছে। সেটা অসুস্থ হওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত। এই সুবিধার পরিমাণও সরকারি সুবিধার মতো। তবে আমাদের মেডিক্যাল টিম সবসময় কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করছে।’
গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকরা কোনো ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার।
তিনি বলেন, ‘সহযোগিতা তো দূরে থাক, কারো করোনা উপসর্গ দেখা গেলে চাকরি থেকেই বাদ দেয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার একটা ঘটনা বলি, একটি গার্মেন্টসে একজন শ্রমিক গিয়ে দেখেন তার চাকরি নেই। তিনি তার সুপারভাইজারের কাছে জানতে চান ‘কেন তার চাকরি নেই? সুপারভাইজার তাকে বলেন, ‘তুমি কোনো কারণ ছাড়াই গতকাল কাজে আসনি, তাই তোমাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।’ তখন ওই কর্মী বলেন, ‘আমি তো ডিউটি করেছি। শুধু ওভারটাইম করতে পারিনি। শারীরিক দূর্বলতার কারণে অফিসের ফ্লোরেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছি।’ তখন সুপারভাইজার তাকে বলেন, ‘তোর করোনা হয়েছে, বাড়ি যা, তোর চাকরি নেই।’ অনেকগুলো ঘটনার এটি একটি। এমন ঘটনা আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে অহরহ হচ্ছে। মালিকরা বরং শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করতে এখন করোনাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।’
বিজিএমইএ’র পরিচালক ও তুসুকা গ্রুপের চেয়ারম্যান আরশাদ জামাল দিপু বলেন, ‘করোনার কারণে শ্রমিকদের জন্য নতুন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে কোনো শ্রমিক মারা গেলে দুই লাখ টাকা পান। এখন আমাদের তো গণহারে শ্রমিকদের করোনা পরীক্ষার সুযোগ নেই, সরকারও সে ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফলে যদি কারো করোনা উপসর্গ দেখা দেয় তাকে বেতনসহ সাত দিনের ছুটি দেয়া হচ্ছে। আমাদের বিজিএমইএ থেকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার সুযোগ নেই। কিন্তু বিজিএমইএর আটটি টিম এই বিষয়গুলো মনিটরিং করছেন। আমাদের উদ্যোগের কারণেই কিন্তু খুব বেশি শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়নি। পুরো গার্মেন্টস সেক্টরে মাত্র ২৭২ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।’
ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা বলা হচ্ছে সাংবাদিকদের। ‘আওয়ার মিডিয়া, আওয়ার রাইটস’ নামের সামাজিক মাধ্যমের একটি মিডিয়া গ্রুপ করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করা সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ করেন। সেখানে দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে ৩৭ জন ও উপসর্গ নিয়ে আরো ১৪ জন সাংবাদিক মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৩২৬ জন।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা সাংবাদিকদের পরিবার কী কোনো ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন? জানতে চাইলে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ‘ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা নিজ প্রতিষ্ঠান থেকেই অনেকে পাওনা পাননি। আমরা বারবার বলার পর মালিকপক্ষ কিছু করছে না। শুধু কল্যাণ ফান্ড থেকে তিন লাখ টাকা করে পান। আমরা সরকারকেও এসব বিষয়ে অবহিত করেছি।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে