বন্ধু, সহপাঠী থেকে সহকর্মী হয়ে ওঠা ওয়াসিমের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পথচলা সোহেল রানার। শুধু পর্দায় নয় বাস্তবেও তারা জুটি ছিলেন। সেই পথচলার সমাপ্তি হয়েছে। চিত্রনায়ক ওয়াসিম পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। বন্ধুকে হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়েছেন সোহেল রানা। ওয়াসিমকে স্মরণ করতে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন। এক পর্যায়ে কান্না থামিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে সোহেল রানা বলেন, ওয়াসিমের চলে যাওয়াটা মেনে নেয়া মুশকিল। চলচ্চিত্র জগতে তিন জন আমাকে তুই বলে সম্বোধন করতো।
তার মধ্যে ও একজন ছিল। ও হয়তো আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু আমি ওকে কোনোদিনও ভুলবো না। ষাটের দশকের পুরনো স্মৃতির কথা মনে করে এই নায়ক বলেন, ওয়াসিম আমার অনেক পুরনো বন্ধু। কলেজে থাকতে ওর (ওয়াসিম) সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। আনন্দমোহন কলেজে ১৯৬৪ সালে একসঙ্গে পড়াশোনা করি।
ও তখন দেহ চর্চা ছাড়া কিছু করতো না। আমি রাজনীতি করতাম, টুকটাক গণ্ডগোল হলে ও মজার ছলে বলতো, শরীরচর্চা কর, তাহলে গণ্ডগোল ভালো করতে পারবি। এরকম দুষ্টামি করতো। আমি ফিল্মের ওপর পেপারে লিখতাম, ওর কিন্তু কোনোকালেই এসব ব্যাপারে উৎসাহ ছিল না। তারপরও যে কোনোভাবে ও চলচ্চিত্র জগতে চলে আসলো। সেটা একটা বিশাল গল্প।
এদিকে চলচ্চিত্রে ওয়াসিমকে অপ্রতিদ্বন্ধি বলে মনে করেন সোহেল রানা। তিনি বলেন, চলচ্চিত্রে ও (ওয়াসিম) অপ্রতিদ্বন্ধি ছিল। ওর সঙ্গে তুলনা করার মতো চলচ্চিত্রে কেউ আসেনি। ভবিষ্যতে আসবে কিনা জানি না। অনেক আন্তরিকতার সহিত কাজ করতো। ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। ও যেসব ছবিতে অভিনয় করতো সেগুলোর জন্য অনেক শারীরিক কসরত করতে হতো। ওর একটা ছবিতে অজগর সাপের সাথে ফাইট ছিল। গল্পের প্রয়োজনে অজগর সাপের সাথে ওর পা থেকে গলা পর্যন্ত জড়িয়ে দেয়া হলো। হঠাৎ সেই সাপটা একসময় ওকে প্রচণ্ড প্রেসার দিল। ২০৬ টা হাড্ডি ভেঙ্গে যাওয়ার মতো একটা অবস্থা হলো। ওয়াসিম তখন সাহায্যের জন্য চিৎকার করলো। পাশের লোকজনরা ফিল করলো, ও অভিনয় করছে এবং অভিনয়টা ভালো করার জন্য এমন করছে। কিন্তু ঘটনাটা সত্যি ছিল। এক পর্যায়ে তারা বুঝতে পারলো ওয়াসিম তার জীবন বাঁচাতে যুদ্ধ করছে। তখন সবাই দৌড়াদৌড়ি করে সাপটাকে ছাড়িয়ে নিল। এরপর অনেক দিনই ওয়াসিমের শরীরে সেই ব্যাথা রয়ে যায়। এই রকম অনেক চ্যালেঞ্জিং চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ওয়াসিম নিজের জীবন বাজি রাখতো। সোহেল রানা আর ওয়াসিম এক হলেই তারা আড্ডা আর খুনসুটিতে মেতে উঠতেন। সেই কথাও জানালেন তিনি।
এই নায়ক বললেন, ওয়াসিম সবসময়ই হাসি, ঠাট্টা, মজার মধ্যে থাকতো। আমার সাথে যেহেতু অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল মাঝেমধ্যে ও জ্ঞান দিতে আসতো। ও নিজে যেটা কখনও করেনি সেই ব্যাপারে জ্ঞান দিতে আসতো। প্রেম করার ব্যাপারে জ্ঞান দিত। ও নিজে কোনো দিন প্রেম করেনি। ওর সব নায়িকাদের সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিল। অথচ আমাকে বলতো এইটা কর, সেইটা কর তাহলে প্রেম হবে। আমি বলতাম, এই বুদ্ধি তুই কাজে লাগাস না কেন! এরকম কিছু কিছু হাসি, ঠাট্টা করতাম আমরা, যেটা অন্য সবার সামনে করতাম না বা করা যেত না। ও আর আমি যে ভাষায় কথা বলতাম ওটা শুনলে অনেকেই অবাক হয়ে যেতেন। শোনেনি ভালো। কেউ শুনলে হয়তো বলতো, এ কি, হায় হায় এরা কি ভাষায় কথা বলে। আমাকে বলতো শালা তোর মাথায় ঘিলু নাই, তুই একটা বলদ। এই ক্যাটাগরির শব্দ ও সবসময়ই বলতো। ওকে আমি আদর করে ‘বুম্বা’ বলে ডাকতাম। এখন দেখি কলকাতায় একজনকে বুম্বা দা বলে ডাকে। কিন্তু আমি ওকে ৪০ বছর আগে থেকে এই নামেই ডাকতাম।
চিত্রনায়ক ওয়াসিমকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে ক্ষোভ ঝারলেন সোহেল রানা। তিনি বলেন, আজকে অনেকে মুম্বইয়ের সালমান খানের বডি নিয়ে লাফালাফি করে কিন্তু ওয়াসিমের সামনে দাঁড়ালে সালমান খানেরও অনেক কিছু খেয়াল করতে হতো। ওয়াসিমের শরীরের রঙটাও ছিল অপূর্ব। চেহারাও ছিল অত্যান্ত সুন্দর। বহু নামকরা ড্রিস্টিবিউশন, প্রোডাকশন সাইট ওয়াসিমকে ভেঙে তারা অনেক বড় হয়েছে। অনেক কিছু করেছে। কিন্তু জীবনের শেষ দিকে সেই লোকগুলো ওয়াসিমকে যতটুকু স্মরণ করা দরকার ততটুকু স্মরণ করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। আর বড় দুঃখজনক যেটা সেটা হচ্ছে, ওয়াসিমকে অকারণেই কস্টিউম ছবির হিরোর একটা ট্যাগ দিয়ে অভিনয়ের লাইন থেকে কিছুটা দূরে রাখার প্রচেষ্টা করা হয়। মজার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে লুঙ্গি, গামছা পরে রিকশাওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করলে মনে করি চরিত্রের সাথে মিশে গেছে। বলি ভালো অভিনয় করেছে। তো রাজার ভূমিকায় কেউ যদি অভিনয় করে সেটা যদি সত্যিকারের অর্থে রাজার মতোই মনে হয় তাহলে কি সে ভালো অভিনেতা নয়? এটা আমার প্রশ্ন সবার কাছে। এমনটা একমাত্র বাংলাদেশেই হয়। পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। কিন্তু ওয়াসিম খুব দুর্দান্ত শিল্পী ছিল। ও বাংলাদেশে এমন একজন হিরো যার কোনো ছবি ফ্লপ করেনি। আমার চোখে ওই একমাত্র সুপারস্টার। কিন্তু ওকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় নি। যারা তাকে একটা তকমা লাগিয়ে বিশেষ সাইডের মধ্যে রেখে কখনও পুরস্কারের জন্য চিন্তা ভাবনা করেনি তারা অথর্ব, মূর্খ, তারা অভিনয় সম্পর্কে কিছু জানে না। পৃথিবী সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।
মানুষ হিসেবে ওয়াসিম কেমন ছিলেন? সোহেল রানা বলেন, ওয়াসিম সবার সঙ্গেই বন্ধুর মতো মিশতো। তাই গ্রহণযোগ্য একটা লোক ছিল। সিগারেটের প্যাকেট বের করলে দেখা যেত ২০ টার মধ্যে ১ টা হয়তো নিজে খেত, আর সবগুলোই সে বিলিয়ে দিত। এই রকম হইচই করে চলতো। একটা সময় চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন ওয়াসিম। এ ব্যাপারে সোহেল রানা বলেন, ওর মেয়েটা মারা যাবার পর ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। ধীরে ধীরে ছবির জগত থেকেও দূরে সরে যায়। মনের মধ্যে একটা আক্ষেপ ছিল। সোহেল রানা-ওয়াসিম বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দারুণ এক জুটি ছিল। এ সম্পর্কে সোহেল রানা বলেন, দুজনে মিলে অনেক ছবি করেছি। কোনটা কোনটার থেকে বেশি হিট এইটা নিয়ে বিতর্ক করতে হবে। প্রযোজক-পরিচালকদের কাছে আমরা দুইজন লাকি স্টার ছিলাম। বাংলাদেশে এই ধরনের জুটি নায়ক-নায়কে হয় না।