ঠিক ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে নিভে গেল চলচ্চিত্র আকাশের দুই জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। ১৭ এপ্রিল প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ২০ মিনিট) এলো বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীর মৃত্যুর খবর। তিনি একাধারে মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্র নির্মাতাও বটে। নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি হিসেবেও যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় সংসদ ভবনে।
চলচ্চিত্রের এই মিষ্টি মেয়েকে বিদায় জানানোর বিউগলের সুর না থামতেই চলচ্চিত্রের আকাশে নেমে এলো আরেক দুঃসংবাদ। ঠিক ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রাণ হারালেন বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি দিনের সুপারস্টার ওয়াসিম। শনিবার দিবাগত রাত (১৮ এপ্রিল) সাড়ে ১২টার দিকে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
করোনার কাছে পরাজিত হওয়া কবরীর সঙ্গে ওয়াসিমের পার্থক্য এটুকুই- তিনি ছিলেন নেগেটিভ। বেশ কিছুদিন বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোখে ভুগছিলেন এই বডিবিল্ডার।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই ওয়াসিম ভাই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন রাজধানীর শাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আমরা তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।’
ঢাকাই চলচ্চিত্রের ফিটেস্ট নায়ক হিসেবে দারুণ খ্যাতি ছিলো ওয়াসিমের।
প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক এস এম শফীর হাত ধরে চলচ্চিত্র জগতে অভিষেক ঘটে ওয়াসিমের। ১৯৭২ সালে শফী পরিচালিত ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হন তিনি। এতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন। ১৯৭৪ সালে আরেক প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা মহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ তার। চলচ্চিত্রটির অসামান্য সাফল্যে রাতারাতি সুপারস্টার বনে যান তিনি।এরপর ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া এস এম শফী পরিচালিত ‘দি রেইন’ সিনেমা তাকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়।
১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে শীর্ষ নায়কদের একজন ছিলেন তিনি। ফোক ফ্যান্টাসি আর অ্যাকশন ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা ছিলেন ওয়াসিম। অভিনয়জীবনে ১৫২টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।
কবরীর পর কাছাকাছি সময়ে ওয়াসিমের এমন প্রস্থানে ঢালিউডের আকাশে জমেছে কালো মেঘ। কবরীর শোক কাটিয়ে না উঠতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বাজছে ওয়াসিমকে হারানোর শাব্দিক মাতম।
‘ঢাকা অ্যাটাক’ ও ‘মিশন এক্সট্রিম’-খ্যাত নাট্যকার-নির্মাতা পুলিশ কর্মকর্তা সানী সানোয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ওয়াসিম ভাই ১৯৬৪ সালে বডি বিল্ডিং-এ পূর্ব পাকিস্তান থেকে খেতাব পেয়েছিলেন! যেটা তখন ভাবাই যেতো না। সুঠাম দেহের অধিকারী এই নায়কের প্রতি শৈশবে জন্মেছিল অগাধ ভালোলাগা। তাই শৈশবে (১৯৮৬) বন্ধুদের সাথে জীবনে প্রথম তার সিনেমা দেখতে যাই সিনেমা হলে। সেই সিনেমা দেখার জন্য টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে টিকিট কেটেছিলাম। সেই থেকেই স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখা শুরু আমার। এখনও সেই সিনেমার সঙ্গে আছি। বলা যেতে পারে, ওয়াসিম ভাইর রেশ ধরেই আজ আমার সিনেমা বানানোর হাতেখড়ি। আমাদের চলচ্চিত্রের এক মহিরুহ ছিলেন কবরী ম্যাডাম। তার প্রস্থানের শোক না কাটতে শৈশবের সুপারস্টার ওয়াসিম ভাইও চলে গেলেন! খুবই মর্মাহত হলাম। এটুকুই বলতে চাই, নায়ক ওয়াসিম- তুমি আজীবন আমার কাছে মহানায়ক হয়েই রবে।’
এদিকে ঢাকাই ছবির শেষ যুবরাজ শাকিব খান বলেন, ‘আবারও চলচ্চিত্রাঙ্গনে শোকের মাতম। একের পর এক নক্ষত্রের পতনে শূন্য হয়ে যাচ্ছে এ মাধ্যমটি। কবরী আপা চলে যাওয়ার বিষাদের মধ্যে সোনালি দিনের জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিম আংকেলও মারা গেলেন! তিনি ছিলেন সুঠাম, সুদর্শন ও পরিপূর্ণ এক নায়ক। জেনেছিলাম আংকেল দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। অবশেষে চলে গেলেন। তার চলে যাওয়ায় আরও এক অভিভাবক হারালো বাংলা চলচ্চিত্র। ওয়াসিম আংকেলের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।’
ওয়াসিম অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো- দ্য রেইন, ডাকু মনসুর, জিঘাংসা, কে আসল কে নকল, বাহাদুর, দোস্ত দুশমন, মানসী, দুই রাজকুমার, সওদাগর, নরম গরম, ইমান, রাতের পর দিন, আসামি হাজির, মিস লোলিতা, রাজ দুলারী, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, লুটেরা, লাল মেম সাহেব, বেদ্বীন, জীবন সাথী, রাজনন্দিনী, রাজমহল, বিনি সুতার মালা, বানজারান।
বয়সে কবরীর সমসাময়িক হলেও ওয়াসিম বেশি অভিনয় করেছেন অলিভিয়া, অঞ্জু ঘোষ ও শাবানার সঙ্গে। কবরী-ওয়াসিম; দুজনেরই জন্ম ১৯৫০ সালে। ওয়াসিমের জন্ম ২৩ মার্চ আর কবরীর ১৯ জুলাই। তবে কর্মজীবন আগে শুরু করেন কবরী, ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তর ‘সুতরাং’ দিয়ে। অন্যদিকে ওয়াসিমের শুরুটা হয় ১৯৭২ সালে শফী পরিচালিত ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হিসেবে।
কবরী শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ওয়াসিম নানা রোগ-ভোগে ২০১০ সাল থেকে চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে যান।
ওয়াসিম বিয়ে করেছিলেন চিত্রনায়িকা রোজীর ছোট বোনকে। তাদের দুটি সন্তান হয়– পুত্র দেওয়ান ফারদিন এবং কন্যা বুশরা আহমেদ। ২০০০ সালে তার স্ত্রীর অকালমৃত্যু ঘটে। ২০০৬ সালে ওয়াসিমের কন্যা বুশরা আহমেদ ১৪ বছর বয়সে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। পরীক্ষা চলাকালীন নকলের অভিযোগ তার পরিবারকে জানাবার প্রাক্কালে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে বুশরা লাফ দেন। অন্যদিকে পুত্র ফারদিন লন্ডনের কারডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ব্যারিস্টার হিসেবে আইন পেশায় নিয়োজিত।
অন্যদিকে কবরীর পাঁচ ছেলে। বড় ছেলে অঞ্জন চৌধুরী অনেক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। দ্বিতীয় ছেলে রিজওয়ান চৌধুরী বর্তমানে দুবাইয়ে চাকরি করছেন। তৃতীয় ছেলে শাকের ওসমান চিশতী। তিনি সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানেই বসবাস করছেন এখন। চতুর্থ ছেলে কানাডা প্রবাসী। সবচেয়ে ছোট ছেলে শান ওসমান চিশতী শারীরিক প্রতিবন্ধী।
এদিকে কিংবদন্তি কবরীর পড়াশুনার গণ্ডি স্কুল না পেরুলেও ওয়াসিম ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি বডি বিল্ডার হিসেবে নাম করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি বডি বিল্ডিং-এর জন্য ইস্ট পাকিস্তান খেতাব অর্জন করেছিলেন।