সবাইকে কাঁদিয়ে গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে পরপাড়ে চলে গেলেন বাংলা সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’ খ্যাত অভিনয়শিল্পী সারাহ বেগম কবরী। এই কিংবদন্তি শিল্পীর সঙ্গে আমার এক টুকরো অত্যন্ত আন্তরিক স্মৃতি রয়েছে। এই স্মৃতিটুকু কাল মধ্যরাতে তার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকে বার বার মনকে কাঁদিয়ে যাচ্ছে।
২০০০ বা ২০০১ সাল হবে, আমি তখন দৈনিক মানবজমিনে স্টাফ রিপোর্টার। সে সময় মানবজমিন খুব জনপ্রিয় কাগজ। স্বাস্থ্য বিটে কাজ করি আমি, সিটি করপোরেশনও করি। এর বাইরেও ভিন্নধর্মী কাজ করার চেষ্টা করি।
একদিন সম্পাদক মতি ভাই (মতিউর রহমান চৌধুরী) আমাকে ডেকে একটি অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। অভিনেত্রী কবরীর একটি এক্সক্লুসিভ ইন্টারিভিউ করতে হবে। কিছু দিন আগে বাংলাদেশের প্রথম নারী চিকিৎসক জোহরা বেগম কাজীর ইন্টারভিউ করেছিলাম। বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল ওই ইন্টারভিউ। তাই হয়তো সম্পাদক এবার আমাকে কবরীর ইটারভিউ করতে পাঠালেন।
ফোনে এই শিল্পীর সঙ্গে কথা বলার আগে খুব নার্ভাস ছিলাম আমি। এক সময়ের ব্যাপক জনপ্রিয় অভিনেত্রী, এখন খুব একটা অভিনয় করেন না। আমার মতো একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে কথা বলবেন কিনা! খুব ভাবছিলাম। কিন্তু ফোনের এ প্রান্ত থেকে হ্যালো বলে আমার পরিচয় দিতেই সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। পরের দিন ওনার গুলশানের বাসায় যেতে বললেন। আমি তো মহাখুশি।
পরের দিন যথাসময় সকাল ১০টায় আমি তার বাসার দরজায় গিয়ে হাজির। কে একজন এসে বিশাল ড্রইংরুমে বসতে দিলেন। কিছুটা সময় পেড়িয়ে গেল। অতিযত্নে সাজিয়ে রাখা ড্রইং রুমে আমি বসে আছি। একটু পরই তিনি পর্দা সরিয়ে আমার সামনে এলেন। এই প্রথম আমি রূপালী পর্দার এক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী কবরীকে সামনে থেকে দেখলাম।
সেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, মান্না?। অবাক হয়ে বললেন, তুমি তো দেখি ছোট মেয়ে। আমি তো ভেবেছি আরও বড় কেউ। আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম।
আলাপ-পরিচয়ের ফাঁকে একজন নাস্তা দিয়ে গেল। এরই মধ্যে আমার ফটোগ্রাফার ক্লিক ক্লিক করে অনেকগুলো ছবি তুলে নিয়ে চলে গেলেন অফিসে।
তারপর শুরু হলো আমাদের কথা…। কফি খেতে খেতে কত কথা যে বললেন, আর কত কথা যে আমি জানতে চাইলাম। সেই প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের স্মৃতি থেকে ক্যারিয়ারের কঠিন সময়, এমন কি বিয়ে-বিচ্ছেদ-সন্তান-জনপ্রিয়তা সব নিয়ে কথা বললেন। নিজের কথা শেষ করে জানতে চাইলেন, কেন সাংবাদিকতাকে বেছে নিলাম পেশা হিসেবে। আমার বাসা কোথায়, বাসায় কে কে আছে সব জানলেন।
কথা ছিল ঘণ্টাখানেক কথা বলবেন। কিন্তু কথা বলতে বলতে সময় পেড়িয়ে গেল অনেক।
ঘড়ির কাটায় দুপুর দুটো। সব গুছিয়ে বললাম, এবার তাহলে উঠি। অফিসে যেতে হবে। উনি বাধ সাধলেন। কিছুতেই লাঞ্চ না করে আমাকে ছাড়বেন না। আমি তো আছি মহা টেনশনে। কখন অফিসে ফিরব, আর কখন লিখব ইন্টারভিউটা। কিন্তু কবরী আপা নাছড়বান্দা। আমাকে অনেকটা জোর করে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলেন। নিজ হাতে বেড়ে বড়ে খাওয়ালেন আমাকে। আমি তো অত খেতে পারি না। অথচ আমার সামনে প্রায় নয় থেকে দশ রকমের তরকারি-খাবার। কত যে আয়োজন! আমি অবাক হলাম।
আমার পাতে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, তুমি আসবে বলে আমি নিজে কয়েকটি আইটেম রান্না করেছি। ভালো করে খাও। সাধারণত তো বাসায়ই থাকি না। আজ তোমার সঙ্গে কথা বলা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই।
এত বড় একজন মানুষের এত আন্তরিক ব্যবহারে আমি চমৎকৃত হলাম বার বার। অভিভূত হলাম। ভালো লাগার একটি পরশ হৃদয়ে মেখে ফিরে এলাম অফিসে। একদিন পর ইটারিভিউ লিড হলো। রাতে ফোনে জানালাম, কাল সকালে পত্রিকায় ইটারভিউটা দেখতে পাবেন। আমি কি পত্রিকা দিয়ে যাবো? বললেন, না, না, কাল আমি পত্রিকাটা কিনে নেব। তুমি কিন্তু যোগাযোগ রেখে।
সে ভাবে যোগাযোগ আর রাখা হয়নি। কোথাও আর তার সঙ্গে আমার দেখাও হয়নি। এরপর কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো বছর।
এরই মধ্যে অভিনেত্রী কবরী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। ২০০৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পেলেন এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হলেন।
এ সময় আমি হাউজ বদল করে মাতৃভূমি এবং ভোরের কাগজ ঘুরে কাজ করছি সমকালে। ২০০৮ সাল, তিনি নিজ এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় তখন খুব ব্যস্ত সময় পাড় করছেন।
একদিন আমি নারায়ণগঞ্জে তার এলাকায় গেলাম নিউজ কাভার করতে। সে অনেক দিন পর, এবার নেতা কবরীকে দেখলাম। তিনি লোকজন নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ভোট চাইছেন। বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি সারা পথ। সে পথে শাড়ির কুচি একমুঠ করে ধরে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছেন এক সময়ে ডাকসেটে অভিনেত্রী। নিজের পাশেই আমাকে দেখে ঠিক চিনলেন। সেই চির চেনা হাসি দিয়ে বললেন, মান্না, কি খবর? জিততে পারব তো?!
তিনি সত্যি জিতেছিলেন চলচ্চিত্রের মতো রাজনীতিতে এসেও। তিনি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন।
জীবনের ওপাড়ে আপনি অনেক ভালো থাকুন মিষ্টি মেয়ে কবরী। আমরা আপনাকে কোনো দিনও ভুলব না।
লেখক : আইরীন নিয়াজী মান্না, সম্পাদক, উইমেননিউজ২৪.কম