করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলমান লকডাউনের মেয়াদ আগামীকাল ১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ১৪ই এপ্রিল থেকে পরবর্তী লকডাউনের পাশাপাশি সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এই ৭ দিন জরুরি সেবা ব্যতীত সকল সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। গণপরিবহন বন্ধের পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করা হতে পারে। বন্ধ হবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও। তবে সীমিত পরিসরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু থাকতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানপাট সীমিত আকারে চালু থাকবে। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বৈঠকে এ সংক্রান্ত আলোচনা শেষে বৈঠকের সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদনের পর প্রজ্ঞাপন আকারে তা প্রকাশ করা হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হ্রাস ঘটাতে চলমান নিষেধাজ্ঞা আগামী ১৪ই এপ্রিল ভোর ৬টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, সকল সিনিয়র সচিব ও সচিব, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। গতকাল রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধকল্পে শর্তসাপেক্ষে সার্বিক কার্যাবলী/চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক সূত্রস্থ (১) ও (২) নম্বর স্মারকের অনুবৃত্তিক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ আগামী ১৪ই এপ্রিল ২০২১ ভোর ৬টা পর্যন্ত বর্ধিত করা হলো। এর আগে গত ৫ই এপ্রিল থেকে ১১ই এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত চলাচল ও কাজে নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। পরবর্তীতে গত ৮ই এপ্রিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৯ থেকে ১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় ১৪ই এপ্রিল থেকে ৭ দিনের সর্বাত্মক লকডাউন পালনের ঘোষণা এসেছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে। এই লকডাউনের রুপরেখা তৈরিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নেতৃত্বে অংশীজনসহ সচিব পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া পৃথকভাবে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় উৎপাদনমুখী কারখানা খোলা রাখার দাবি জানিয়েছে উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে গেলে করোনা আরো ভয়াবহভাবে ছড়াবে। ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে সীমিত আকারে কারখানা খোলার বিষয়ে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সীমিত পরিসরে অথনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখার বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের কর্মস্থলে রেখে কিংবা কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে উৎপাদন চালু রাখা হতে পারে। এলাকাভিত্তিক প্রয়োজন বিবেচনায় তফসিলি ব্যাংকগুলোর কিছু কিছু শাখা খোলা রাখা হতে পারে। একইসঙ্গে পুঁজিবাজারও সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য চালু থাকতে পারে। সূত্র আরো জানায়, করোনার সংক্রমণ রোধে জনসমাগম কমাতে ও মানুষের চলাচল সীমিত করতে প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হবে। প্রয়োজনে নির্দেশ অমান্যের পরিপ্রেক্ষিতে জেল-জরিমানার ঘোষণাও থাকতে পারে। তবে আপাতত প্রশাসনের সহযোগী হিসেবে সেনাবাহিনী নামানোর কোনো পরিকল্পনা নেই বলে সূত্র জানিয়েছে। বিধিনিষেধের বিষয়গুলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আজকের মধ্যে জারি করা হতে পারে। এই বিধিনিষেধ প্রাথমিকভাবে ৭ দিনের জন্য কার্যকর হলেও প্রয়োজনে এর মেয়াদ বাড়তে পারে।
প্রসঙ্গত, চলমান ৭ দিনের লকডাউনে বড় শহরগুলোতে গণপরিবহন এবং দোকানপাট, শপিং মল বন্ধের সিদ্ধান্ত শিথিল করা হয়েছিল। এছাড়া সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি অফিসকে সীমিত জনবল দিয়ে কাজ করাতে বলা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) বাড়ির বাইরে বের হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তরাঁয় কেবল খাবার বিক্রি ও সরবরাহ করা যাবে বলে বর্তমান নির্দেশনায় রয়েছে। তবে অনেক রেস্তরাঁই তা মানেনি। নির্দেশনা বাস্তবায়নে সারা দেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে জানানো হলেও গত বছরের মতো তৎপরতা এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না সাধারণ মানুষের মধ্যে। সরকারের মন্ত্রীরাও খোদ বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ পরিস্থিতিতে দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউন ছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে মত দিয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। এজন্য সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকায় দুই সপ্তাহের পূর্ণ লকডাউন দেয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।
বন্ধ থাকছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট: প্রস্তাবিত ১৪ই এপ্রিলের ‘কঠোর লকডাউন’-এ বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)-এর চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এ মফিদুর রহমান। রোববার গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন তিনি। গত ৫ই এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী সাতদিনের লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। তবে চলমান লকডাউন ১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আর দ্বিতীয় দফা কঠোর লকডাউন শুরু হচ্ছে ১৪ই এপ্রিল থেকে। এয়ার ভাইস মার্শাল এ মফিদুর রহমান বলেন, ওই সময়ে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকছে। তবে কার্গো বিমান চলাচল করবে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বৃটেন ছাড়া ইউরোপের ২৭ দেশ, ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, পেরু, উরুগুয়ে, মধ্যপ্রাচ্যের বাহরাইন, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, কাতার, তুরস্ক এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। ১৮ই এপ্রিল পর্যন্ত ওই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকছে বলে জানিয়েছে বেবিচক। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক রুটে নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধ থাকলেও বিশেষ ফ্লাইট চলতে কোনো বাধা নেই। বেবিচক চেয়ারম্যানের ভাষ্য মতে, বিশেষ বিবেচনায় কোনো বিশেষ ফ্লাইট থাকলে সেটা পরিচালনা করা হবে।
ব্যাংক লেনদেনের সময় বাড়লো: মহামারির মধ্যে ১৪ই এপ্রিল থেকে ‘কঠোর লকডাউন’ শুরুর আগের দুইদিন ব্যাংকগুলোতে আধা ঘণ্টা বাড়তি সময় লেনদেন হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার এক সার্কুলারে জানিয়েছে, ১২ই এপ্রিল এবং ১৩ই এপ্রিল ব্যাংকে লেনদেন হবে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত। আর লেনদেনের পরবর্তী আনুষঙ্গিক কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখা এবং প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনে বিকাল ৩টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। লেনদেনে বিধিনিষেধ দেয়ার পর ব্যাংকিং লেনদেন ছিল সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। তবে এই স্বল্প সময়ের কারণে শাখা পর্যায়ে ভিড় বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক লেনদেনের সময় বাড়িয়েছে। লকডাউনের কড়াকড়ির কারণে গত ৫ই এপ্রিল থেকে ব্যাংকে লেনদেন হচ্ছিল সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।