শুক্রবার করোনা আক্রান্ত একজন রোগীকে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তির মতো সিট খালি না থাকায় কয়েক ঘণ্টা এম্বুলেন্সে রোগী রেখে অপেক্ষা করেন। সিটের ব্যবস্থা না হওয়ায় ঘুরে আসেন আরো কয়েকটি হাসপাতালে। সব স্থানে একই অবস্থা। এরপর রোগী নিয়ে চলে যান কিশোরগঞ্জ। রোগীকে তার গ্রামের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসেন। করোনা রোগী নিয়ে যাওয়ায় সেখানে স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়তে হয় এম্বুলেন্স চালক রিপন পাটোয়ারীকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ‘ঢাকা এম্বুলেন্স মালিক সমিতি’র অধীনে গত প্রায় ২০ বছর ধরে এম্বুলেন্স চালান তিনি।
তিন ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে পুরান ঢাকার হোসনি দালান এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। করোনাকালের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা নিয়ে মানবজমিনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় তার। চালক রিপন পাটোয়ারী বলেন, করোনাকালীন সময়ে অনেকেই করোনা থেকে দূরে থাকে। এমন একটা পেশায় আছি যেখানে আমরা রোগীকে দূরে ঠেলে দিতে পারি না। তিনি গত শুক্রবার ৪২ বছর বয়সী করোনা আক্রান্ত একজন রোগীকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ভর্তি করতে পারেন নি। সেখান হতে রাজধানীর তিন থেকে চারটি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও কোথাও তার ভর্তির ব্যবস্থা করা যায়নি। সর্বশেষ নিরুপায় হয়ে রোগীর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে চলে যেতে হয়েছে। সেখানে যাওয়ার পর এলাকার লোকজন তাদেরকে গাড়ি থেকে নামতে দেয়নি। আশেপাশের লোকজন বলছিল এখান থেকে চলে যান। তখন কোথায় যাবে রোগী। এর চেয়ে কষ্টের আর কিছুই তো থাকতে পারে না। অবশেষে রোগীকে অন্যত্র নামিয়ে চলে আসার পথে তাড়া করে গ্রামের লোকজন। তারা জানতে চায়, করোনা আক্রান্ত রোগী নিয়ে কেন এসেছি। এই চালক বলেন, রোগীর আপন লোকজন দূরে থাকলেও আমাদের সার্ভিসে রোগীর পাশে এমনভাবে থাকতে হয় মনে হয় আমরাই রোগীর স্বজন। এভাবে আমরা সেবা দিয়ে থাকি। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আমাদের বাধ্য হয়ে রোগীর কাছে থাকতে হয়। আক্ষেপ করে এই চালক বলেন, আমরা সরকারের তরফে কোনো স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী পাচ্ছি না। এগুলো আমাদের নিজ খরচে কিনে ব্যবহার করতে হয়। একজন সাধারণ রোগী যখন সেবা চাচ্ছে তখন এটা নিজেদের বহন করতে হয়। সাধারণ রোগীর মতো করোনা আক্রান্ত রোগীকেও পর্যাপ্ত সেবা দিয়ে থাকি। কিন্তু স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় এই সামগ্রীগুলো পেলে হয়তো স্বাচ্ছন্দ্যে সরকারের পাশাপাশি আমরাও মানুষের সেবা করতে পারবো।
তিনি বলেন, ছোট মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসি। কিন্তু বাসায় ফিরে মন চাইলেও তাকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারি না। এরচেয়ে আর কষ্টের কি থাকতে পারে। পাশাপাশি পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তা তো আছেই। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবাই দূরে সরে থাকলেও আমরা চলে যেতে পারি না। করোনাকালীন এই সময়টাতে এই সেবায় আমাদের না আছে ঈদ, না আছে ছুটি। আমাদের কাছে দিন-রাত সব সমান। ২৪ ঘণ্টাই আমাদের ডিউটির মধ্যে থাকতে হয়। এম্বুলেন্সই আমাদের ঘরবাড়ি। কাজ শেষে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ি। পরিবারগুলো যদি আমাদেরকে সহযোগিতা না করতো তাহলে সাধারণ মানুষের দুরবস্থাটা আরো বেড়ে যেত। তারপরেও আমরা নিজেদের সুখ-দুঃখ সবকিছু উজাড় করে দিয়ে রোগীর সেবা দিচ্ছি। তিনি বলেন, একজন করোনা রোগীর জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে অক্সিজেন। একটি অক্সিজেন সাপোর্ট আনতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এ বিষয়ে ঢাকা এম্বুলেন্স মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. বাবু বলেন, ঢাকা সিটির মধ্যে হাসপাতাল প্রতি ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের অক্সিজেন স্বল্পতা, পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এসব সুরক্ষা সামগ্রী যদি সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দেয়া হয় তাহলে আমরা রোগীর সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে পারবো।