স্ট্রেচারে পড়ে আছে রাজু মিয়ার মরদেহ। পাশে মা-স্ত্রী। তাদের কান্নায় ভারি হাসপাতাল চত্বর। স্ত্রী নাসরিন চিৎকার করে বলছেন, আমি কিচ্ছু চাই না। শুধু একবার তুমি কথা বলো। আমার দিকে তাকাও। তোমারে ছাড়া আমি কী নিয়ে বাঁচবো। আমার আর কিছুই রইলো না।
তিনটা বাচ্চা নিয়ে আমি এখন কোথায় যাবো, কী করবো? আর মা রাবেয়া খাতুন ছেলের লাশকে জড়িয়ে গগণবিদারী কান্নায় ভুক ভাসাচ্ছেন। আমি এখন কেমনে থাকমুরে রাজু, তুই গেলি আমারে লইয়া যায়। বুক থাপড়ে এক মায়ের এমন কান্নায় আশপাশের সবার চোখেই পানি। সন্তানহারা মাকে কিভাবে সান্তনা দেবে?
এ এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। গতকাল বিকাল তিনটা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টের রোগী রাজু মিয়াকে (৪২) নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে আনা হয় এখানে। ভর্তি করানোর আগে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান ধামরাইয়ের বাসিন্দা রাজু মিয়া। তার এমন চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি স্বজনরা। তার মা, স্ত্রী, শাশুড়ি ও শ্যালকের কান্নায় এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়।
রাজু মিয়ার স্ত্রী নাসরিন বেগম মানবজমিনকে বলেন, আমার স্বামী একজন বাসচালক। তিন-চারদিন ধরেই তার বুকে ব্যথা করছিল। আগে থেকেই ডায়াবেটিসের সমস্যা ছিল। রোববার ও সোমবার পর পর দুদিন দুজন স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেছি। বাসায় থেকে তাদের দেয়া ওষুধ খেয়েছে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং সমস্যা আরো বাড়ছিল। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজখবর নিয়ে কোথাও ভর্তির ব্যবস্থা করতে পারেননি। গতকাল তাকে নিয়ে সাভার সরকারি হাসপাতালে যাই। সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পেরে সকাল ১০টার দিকে নিয়ে যাই সাভারের সুপার মেডিকেল হসপিটালে। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি না করে ৮ হাজার টাকা নিয়ে একটি সিটিস্ক্যান করান। দুপুর ১২টার পরে সেখানকার চিকিৎসকরা সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট দেখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। ততক্ষণে আমার স্বামীর অবস্থা গুরুতর হয়ে যায়। অনেক কাকুতি-মিনতি করে ওই হাসপাতালে একটু চিকিৎসা দেয়ার অনুরোধ করেও তাদের মন গলাতে পারিনি। ভেবেছিলাম তাকে নিয়ে মানিকগঞ্জ চলে যাবো। সেখানে গেলে অন্তত চিকিৎসাটা দ্রুত শুরু করা যেত। কিন্তু সুপার মেডিকেলের কথায় দুপুর আড়াইটার পরে নিয়ে আসি এখানে। আসার পর আমার ভাই টিকিট কেটে ভর্তি করানোর তোড়জোড় করছিল। আমি আমার স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম আর দেখছিলাম তার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কোনো কথা বলতে পারছিল না। আমি বারবার তাকে বলছিলাম আর একটু ধৈর্য ধরো। তোমার চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে। এর মধ্যেই হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে গেল। কষ্ট করে যেটুকু নিঃশ্বাস নিচ্ছিল সেটুকুও বন্ধ হয়ে গেল। নাসরিন বলেন, সাভার সুপার হাসপাতালে নেয়ার আগে সে আমাকে বলে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। তাকে চিকিৎসা করানোর জন্য। বারবার বলছিল আমাকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও, আমি মরে যাবো।
রাজু মিয়ার শাশুড়ি আমেনা বেগম বলেন, আমার একটি মাত্র মেয়ে। তার স্বামীর এভাবে চলে যাওয়া আমি মেনে নিবো কীভাবে। আমার মেয়েটা কী নিয়ে বাঁচবে। আমার চোখের সামনেই ছেলেটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। রাত ১২টায় তার অসুখ বেড়েছিল। তারপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোনো চিকিৎসককে দেখাতে পারিনি। অপেক্ষা করতে করতে, আর রাস্তায় ঘুরে সময় গেছে। অন্তত একটু অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা গেলেও তাকে হয়তো বাঁচানো যেত। রাজু মিয়ার শ্যালক আরিফ বলেন, এই হাসপাতালে আসার পরপরই আমি একটি টিকিট কেটেছি। ভগ্নিপতির অবস্থা খারাপ দেখে চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আনসার সদস্যরা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। তারা আমাকে বলে এখন ভেতরে কেউ নেই। পরে আসেন। বাইরে অপেক্ষা করেন। তাদের কথামতো অপেক্ষা করে মানুষটাই মারা গেল।
ধামরাই উপজেলার ধামরাই ইউনিয়নের বাসিন্দা রাজু মিয়া ও নাসিরন বেগমের বিয়ে হয়েছিল ১৪ বছর আগে। রাজু মৃত মোসলেম উদ্দিন ও রাবেয়া খাতুনের ছেলে। রাজু ও নাসরিনের ঘরে দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। এরমধ্যে বড়মেয়ে রেশমার বয়স ১২ বছর। ছেলে রাকিবের ৮ ও ছোট মেয়ে রাইমার বয়স ৫ বছর। রাইমা ছাড়া রাকিব ও স্কুলে লেখাপড়া করে।