যুক্তরাজ্য থেকে ডা: আলী জাহান:
১.করোনার প্রথম ঢেউয়ে আপনি, আমি হয়তো বেঁচে গিয়েছি। এবার বাঁচতে পারবো তো? আপনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্র এবং সমাজ আপনার জন্য যা করার দরকার তা করেছে? যারা এসে আপনার দরজায় কড়া নেড়ে বলেছিল, ‘আমরা আপনাকে নিরাপত্তা দেবো, অসুস্থ হলে স্বাস্থ্যসেবা দেবো, অভুক্ত হলে খাবার দেবো, আতঙ্কিত হলে নিরাপত্তা দেবো’ তারা এখন কী করছেন? উনারা এখন কোথায়? ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আপনি সেই দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। দায়িত্ব হাতে তুলে দিয়েই আপনি ক্ষান্ত হননি। তাদেরকে ট্যাক্স দেবার মাধ্যমে নিয়মিত বেতন দিয়ে যাচ্ছেন। বাজার থেকে যখন ১০ টাকা দামের কিছু কিনতে যান সেখানে আপনাকে ১.৫ টাকা ভ্যাট আকারে এই মহামানবদের দিতে হয়। টেলিফোনে যখন কথা বলেন সেই বিল থেকে একটি অংশ তাদের দিতে হয়। ব্যাংকে ১০,০০০ টাকা রাখার পর এক বছরে যদি সেখানে ১০০ টাকা মুনাফা আসে সেখান থেকেও এই মহান ব্যক্তিদের আপনাদের ১৫ টাকা দিতে হয়। আপনাদের দেয়া টাকা থেকে উনারা চলেন, গাড়ি হাঁকান, দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরেন, মালয়েশিয়া কানাডায় দ্বিতীয় বাড়ি করেন, ছেলেমেয়েদের দেশের বাইরে রেখে পড়াশোনা করান।
প্রতি পাঁচ বছর পর পর ওনারা আপনাদের সামনে আসেন। এসে বলেন- আপনাদের সেবা করার জন্য আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করবো। আপনারা তাদের কথা বিশ্বাস করেন। তাদেরকে নিয়ে মিছিল করেন। হই- হুল্লোড়, আনন্দ-উৎসব করেন।আপনারা ভাবেন, বিপদের সময় উনারা আপনাদের সাহায্য করবেন। বিনা চিকিৎসায় বা অভুক্ত হয়ে উনারা আপনাকে মরতে দেবেন না। লঞ্চ ডুবি হয়ে নিজের কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আপনি পানির তলদেশে হারিয়ে যাবেন না। রোড এক্সিডেন্টে মারা পড়ে রাস্তায় আপনি বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকবেন না।কিন্তু আপনি দেখতে পান, আপনার আত্মীয় স্বজনরা বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালে করিডোরে, রাস্তায় মারা পড়ছে। অক্সিজেন অক্সিজেন করে চিৎকার করতে করতে এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করার মাঝে রাস্তায় আপনার প্রিয় স্ত্রী বা মা বাবা ভাই এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছেন। প্রিয় সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা-বাবা নদীর তলদেশে লাশ হয়ে পড়ে আছেন। আপনার কোন ভাই বা বোন রাস্তায় কোন দানবের হাতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তাক্ত লাশ হয়ে পড়ে আছে। আপনারই খুব পরিচিত একজন হঠাৎ করে গুম হয়ে যায়। রাষ্ট্র তার খবর দিতে পারে না। সৌভাগ্যবান হলে হঠাৎ করে একদিন তার লাশ আপনার হাতে আসবে। ভাগ্য খারাপ হলে, লাশটাও আপনার হাতে আসবে না। আপনি ভাবছেন আপনি নিরাপদ আছেন! আপনার কিছুই হবে না! ক্ষমতার বৃত্তে বা পাশাপাশি থাকলে অন্য ঝুঁকি কিছুটা কম হলেও করোনার হাত থেকে আপনার রেহাই নেই। করোনা ক্ষমতার বৃত্ত চেনে না। রাজা – প্রজা সবাই তার কাছে সমান। ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারবে না। করোনা কাউকে নিস্তার দেবে না।
২. করোনাকে মোকাবেলা করার জন্য যে সামর্থ্য যোগ্যতা থাকা দরকার তা আমাদের নেই। কিন্তু আমরা তা স্বীকার করি না। বাগাড়ম্বর করি। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেন কিছু দিনের ভেতরেই করোনা বিদায় নেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের করোনা ম্যানেজমেন্ট দেখে নাকি প্রশংসা করেছে। করতেই পারে। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানে না দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ করোনা টেস্ট করাতে ফি ধার্য করেছে। সেই ফি ধার্য করার পরই লোকজনের টেস্ট করানোর আগ্রহ কমে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা কমে গেছে, কারণ টেস্ট হয় না। রোগ ডায়াগনোসিস হয়ে মারা যাবার সংখ্যাও কমে গেছে। আমরা দাবি করেছি যে, আমরা করোনা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আমরা সত্যি বলিনি। আমরা অসত্য তথ্য দিয়েছি। সেই অসত্য তথ্য দেবার পরিণতি এখন টের পাচ্ছি। ২০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে প্রতিদিন গড়ে পরীক্ষা হচ্ছে ২০ থেকে ২২ হাজার। এর এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার দেশ যুক্তরাজ্যের প্রতিদিন পরীক্ষা হচ্ছে গড়ে ১২-১৩ লক্ষ। বলতে পারেন যুক্তরাজ্য হচ্ছে উন্নত বিশ্বের একটি দেশ। আর বাংলাদেশ? ক’দিন পর পরই শুনতে পাই বাংলাদেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক এবং কানাডার জিডিপি ছাড়িয়ে যাচ্ছে! রাজা উজিররা তো এরকম কথাই বলেন। এখন কী বলবেন?
৩. আমরা একদিকে করোনা টেস্ট করানোর জন্য ফি ধার্য করেছি, অন্যদিকে মানুষজনকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করছি। সেই টিকা নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড হচ্ছে। প্রথম ডোজ নেয়ার ৪-৬ সপ্তাহ পর অহরহ মানুষজন করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, কেউ কেউ মারা যাচ্ছেন। কেন এমন হচ্ছে? কোনো স্টাডি হয়েছে বা হচ্ছে বাংলাদেশে? আমার জানা নেই। সাধারণ মানুষ প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে লোকজন ভ্যাকসিনের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। আজকের দৈনিক মানবজমিনের রিপোর্ট অনুসারে ভ্যাকসিন নেয়া লোকদের সংখ্যা সর্বনিম্ন ১৩ হাজার ২৮ জনে দাঁড়িয়েছে। এমনটা কেন হচ্ছে? কোনো গবেষণা হচ্ছে? এসব করার কি সময় আছে? তারচেয়ে বরং লাইভ টকশোতে গিয়ে কথা বললে ভালো। বাস্তবে তাই হচ্ছে। মানুষ মারা পড়ছে। চিকিৎসা খরচ যোগাতে গিয়ে পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা নাকে তেল দিয়ে আছি।
৪. না, আমার জানামতে কোনো গবেষণা হচ্ছে না। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে কেন লোকজন মারা যাচ্ছে- এর ব্যাখ্যা কী? করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে লোকজন কেন আবার আক্রান্ত হচ্ছে এর ব্যাখ্যা কী? কাকে প্রশ্ন করবো? কে জবাব দেবে? করোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ-নিষেধের পরিপত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দিচ্ছে। উনাদের কাছে তো এই বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত থাকার কথা নয়। চিকিৎসা পেশায় যারা জড়িত একমাত্র তারাই এর উত্তর দিতে পারবেন। কিন্তু উনাদেরকে তো আমরা খুঁজে পাচ্ছিনা। এসব বিষয় তদারকি করার জন্য ১৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি রয়েছে। উনারা কেন সামনে এগিয়ে আসছেন না? কেন সাংবাদিক সম্মেলনে আসছেন না? কেন মানুষের মনে জেগে ওঠা অসংখ্য প্রশ্নের কোনো জবাব দিচ্ছেন না?
৫. গত বছরে বাংলাদেশের বহুল পরিচিত দু’জন স্বনামধন্য চিকিৎসক ঘোষণা করেছিলেন করোনা নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই, এটি সাধারণ সর্দি-কাশির মতো।উনাদের সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যের ভিডিও এখনো ফেসবুক এবং ইউটিউবে রয়েছে। আসলেই তাই? এসব বক্তব্যের পক্ষে কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? সাধারণ সর্দি কাশি বুঝি এভাবে ছড়ায়? সাধারণ সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হলে এভাবে আইসিইউ বেড আর অক্সিজেনের জন্য মানুষ হন্য হয়ে ঘুরে? সাধারণ সর্দি জ্বর হলে বুঝি মৃতের হার ৫-১০% হয়ে যায়?
৬. করোনা নিয়ে এই হ-য-ব-র-ল অবস্থার জন্য দায়ী কে? সব দোষ কি সাধারণ মানুষের? তাই যদি হয়, তাহলে কেন তাদের কাছে এই ওয়াদা দিয়েছিলেন যে, আমরা আপনাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবো? তখন কি বুঝতে পারেননি যে জনগণ কিছুটা জটিল প্রকৃতির! যিনি কয়েকদিন আগে বলেছিলেন বাংলাদেশ থেকে করোনা বিদায় হয়ে যাচ্ছে তিনি এখন বলছেন সারা ঢাকা শহর হাসপাতালে পরিণত করা হলেও রোগী সামলানো যাবে না। এর মধ্যে আরেক মহান ব্যক্তির একটি বক্তব্য গতকাল চোখে পড়েছে। উনি বলেছেন, যে বাসায় করোনা রোগী থাকবে সেই বাসায় লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়ার জন্য। কেন? লাল পতাকা দেখে কি করোনা পালিয়ে যাবে? না মানুষ পালাবে? কেউ পালাবে না। আমরা হচ্ছি সেই জাতি যে জাতির লোকজন লকডাউন কেমন চলছে তা দেখার জন্য রাস্তায় নেমে আসে।
৭. করোনা সন্ধানের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কেমন? একটু দেখা যাক। বাংলা ট্রিবিউনের আজকের (০৭.০৪.২১) রিপোর্ট অনুসারে রাজধানীর সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড রয়েছে ৩০৫ টি। এই মুহূর্তে খালি রয়েছে মাত্র ২০ টি। ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা কতো? বিভিন্ন জেলা শহর থেকে আইসিইউ এর জন্য ঢাকায় আসা রোগীর সংখ্যা হিসেবের মধ্যে নাই নিলাম। ভয় পাচ্ছেন? আপনাদের ভয় এবং আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আজকের বক্তব্য- করোনা পরিস্থিতি সামলাতে পারছিনা। আপনি যদি রাজা, উজির প্রকৃতির কেউ না হন তাহলে আইসিইউ বেড পাবার সম্ভাবনা আপনার নেই বললেই চলে। করোনা আক্রান্ত হলে আপনার বা আমার মৃত্যু হতে পারে দুই হাসপাতালের মাঝখানে রাস্তায় অথবা বাসায়। দৈনিক প্রথম আলোর ১৪.০৩.২১ তারিখে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে গত এক বছরে ৩৬ জেলায় করোনা পরীক্ষা কেন্দ্র (আর টি পি সি আর ল্যাব) স্থাপিত হয়নি। একটু ভয় পেলেন? ভয় আপনাকে পেতেই হবে। আরো দুঃসংবাদ আছে। কদিন আগে দৈনিক মানবজমিনের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে করোনায় জর্জরিত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম টেস্ট হচ্ছে বাংলাদেশে- যা ইরাক এবং ফিলিস্তিনের চেয়েও কম। আতঙ্কিত হোন। আপনার ভেতর আতঙ্ক আসতেই হবে। আতঙ্ক আসলেই আপনি সতর্ক হবেন। তা না হলে আপনি করোনার পরবর্তী শিকারে পরিণত হতে পারেন।
৮. আমাদের হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির আরও একটি উদাহরণ দিয়েই লেখার সমাপ্তি করছি। আপনাদের হয়তো অনেকের মনে আছে, ২৭.০১.২১ তারিখে যুক্তরাজ্য থেকে সিলেট আসা কোয়ারেন্টিনে থাকা ১৫৭ জন যাত্রীর বেসরকারি সীমান্তিক হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার পর ২৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এত বেশি সংখ্যক লক্ষ্যের পজিটিভ আসায় একটু সন্দেহ হয়। বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরের দিন এই ২৮ জন যাত্রীর নমুনা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো হলে তাদের মধ্যে ২৫ জনের নেগেটিভ ফলাফল আসে। তড়িঘড়ি একটি তদন্ত কমিটি হয়। তদন্তের ফলাফল কী? আপনারা কেউ জানেন? আমি পত্রিকা ঘেঁটে পাইনি। দু’জন তো সঠিক হতে পারে না। একজন নিশ্চয়ই ভুল রিপোর্ট করেছে। তারপর? তারপর কী হলো?
৯. বাংলাদেশ সরকার লকডাউন দিয়েছিল কিন্তু দু’দিনের মাথায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। কেন? নিশ্চয়ই কোথাও কোনো সমস্যা আছে। লকডাউন কেন প্রয়োজন তা জনগণকে বুঝাতে নিশ্চয়ই ব্যর্থ হয়েছেন। খেটে খাওয়া বা সীমিত আয়ের মানুষদের সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।অথবা যাদের মাধ্যমে এই লকডাউনের প্রশ্ন এসেছে তারা তা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। আমি বাংলাদেশে থাকি না, কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থানরত আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের জন্য আতঙ্কে থাকি। কখন যে কী হয়ে যায়! ক্ষমতার বৃত্ত থেকে আমরা অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছি। আইসিইউ বেড যোগাড় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। করোনা যদি হানা দেয় তখন দ্বিতীয় মৃত্যুর হাতছানি বাস্তব হয়ে উঠতে সময় লাগবে না। আপনারা যারা পাঠক আছেন, অনেকের হয়তো একই অবস্থা। সতর্ক হোন। আপনার সুরক্ষা আপনাকেই করতে হবে। কেউ আপনাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না। মনে রাখবেন, আপনি যদি মারা যান সরকারের কাছে নিতান্তই একটি সংখ্যা। কিন্তু আপনার পরিবার-পরিজনের কাছে আপনিই পুরো পৃথিবী। আপনার পৃথিবীকে এখন আপনাকেই রক্ষা করতে হবে। যারা আপনাকে রক্ষা করার কথা বলেছেন উনারা এখন বলছেন, সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আপনি অন্তত আপনার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখুন। বলা যায় না দ্বিতীয় মৃত্যুর হাত থেকে আপনি রক্ষা পেলে পেয়েও যেতে পারেন।
ডা: আলী জাহান
যুক্তরাজ্যে কর্মরত বাংলাদেশী চিকিৎসক
[email protected]