দেশে হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার আবার বেড়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণের কথা উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা হঠাৎ করে বাড়েনি। এটা ছিল। কিন্তু প্রথমদিকে আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। আক্রান্তের সংখ্যা জমে একপর্যায়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে একাধিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মানবজমিনের সঙ্গে কথা বলেছেন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, হঠাৎ করে করোনা আক্রান্তের বিষয়টি চোখে পড়েছে আমাদের। যখন সংক্রমণটা কমে গেলো তখনই আমরা অনেক কাজকর্ম শুরু করেছি কোনোরকম সাবধানতা অবলম্বন না করেই।
সামাজিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় প্রার্থনা, গান-বাজনা সবই হচ্ছে। বদ্ধ ঘরে অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকা। সংক্রমণটা তখন থেকেই বাড়ছিল। কিন্তু যেহেতু অধিকাংশ লোককেই হাসপাতালে যেতে হয় না। ফলে তারা টেস্ট তেমন করায়নি। যাদের অবস্থা খারাপ হয়েছে তারা হাসপাতালে এসেছে। টেস্ট করে তাদের করোনা পজেটিভ হয়েছে।
সাবেক এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, আক্রান্তের সংখ্যা জমতে জমতে হাসপাতালে আসতে শুরু করে গত মাসের তৃত্বীয় সপ্তাহের দিকে। যখন খারাপ অবস্থা হয়ে যায়। আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু এটা ছিল। আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। এখন অনেক বেশি হওয়ার কারণে এটা আমাদের চোখে ধরা পড়েছে। এ ছাড়া করোনা ভ্যাকসিন নেয়ার পরে একটি গা-ছাড়া ভাব চলে এসেছে আমাদের, আর করোনা নেই। ফলে এটা আরো বেড়েছে। কাজেই, লকডাউন হচ্ছে করোনা নিয়ন্ত্রণের সর্বশেষ অস্ত্র। কিন্তু লকডাউনতো বেশিদিন রাখা যাবে না। কারণ, আমাদের দেশের রাষ্ট্র এবং সরকার ব্যবস্থা সকল নাগরিকের খাওয়া পড়ার নিশ্চয়তা দিতে না পারার ফলে প্রান্তিক মানুষদেরকে খাওয়া পড়ার ব্যবস্থা করা কঠিন। ফলে লকডাউন হয়তো দীর্ঘায়িত করা যাবে না। কিন্তু আমাদের যেখানে যেখানে ভিড় বেশি, সংক্রমণটা বাড়ে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। দরজা-জানালা খোলা রাখা, ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা বাড়ানো। সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই মুহূর্তে লকডাউন হলো অগতির গতি। কিছুই করা যায় না তখন লকডাউন দেয়া হয়।
দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এটা বাড়ার মূল কারণ হলো মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছিল না। মাস্ক না পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখা। সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, পর্যটনকেন্দ্র, বিনোদনকেন্দ্র সর্বত্রই লোকে লোকারণ্য। মিছিল-মিটিং হচ্ছে। কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এজন্যই ছড়িয়েছে। যখন সংক্রমণের হার কমে আসছিল তখন মানুষের মধ্যে একটি গা ছাড়া ভাব এসে গেছে। ৫ ভাগের নিচে আসাতে মানুষ ভেবেছে করোনা মনে হয় নেই। আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। এটাও একটা কারণ হতে পারে। এ ছাড়া একটি গ্রুপ আছে যারা টিকা নেয়ার পর ভেবেছে তাদের আর করোনা হবে না। এটাও একটা ভুল ধারণা। টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে মানুষ দেশে আসছে। তাদের ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন হয়নি। সব মিলিয়েই দেশে করোনা বেড়েছে। করোনা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। শুধু আমরা ভালো থাকলেই হবে না। পৃথিবীর অন্য দেশে ছড়ালে আমাদের এখানেও ছড়াবে। পৃথিবীর অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের অনেক দেশে লকডাউন, কারফিউ চলছে। আমাদের এখানে এটা ভীষণভাবে ছড়িয়ে গেছে। এখন যেখাযাক লকডাউন কতোটুকু কার্যকর হয়। এখন বলাতো মুশকিল। প্রথমবার লকডাউন ওভাবে মানুষ মানেনি। এখনো সাধারণ মানুষের খাওয়াপড়া নিশ্চিত না করলে লকডাউন ওভাবে কার্যকর হবে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, মানুষ কোনো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না। এখন অসুস্থ যাতে না হয় সেটাকে বেশি কার্যকর করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ভাইরাসের কোনো চিকিৎসা নেই। যাদের শরীরে ইমিউন পাওয়ার বেশি তারা করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। আর যারা অসুস্থ তারা হয়তো মারা গেলো। প্রথমত, স্বাস্থ্যবিধি না মানা, কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, জনসমাগম বন্ধে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়া, বিদেশ থেকে যারা এসেছে তাদের সঠিকভাবে কোয়ারেন্টিন না করা ইত্যাদি। আমরা ভেবেছি হয়তো করোনা জয় করে ফেলেছি। কাজেই এখন এই লকডাউন সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলে লকডাউন কার্যকর হবে। কিন্তু ভাইরাসটি কতোটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সেটা দেখার বিষয়। কারণ, ইতিমধ্যে ভাইরাসটি যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তার একটি খারাপ প্রভাব আমাদের উপর আসবেই।