করোনা বেড়ে যাওয়ায় সোমবার থেকে আবারো লকডাউনে যাচ্ছে দেশ। এ খবরে শ্রমজীবী মানুষের মাথায় হাত পড়েছে। করোনা নয় ভাতের অভাবেই তাদের মরতে হবে। এদিকে দ্বিগুণ গাড়ি ভাড়া দিয়ে গ্রামে ফেরারও উপায় নেই বলে জানিয়েছেন তারা। রাজধানীতে রিকশা চালান কুষ্টিয়ার সেলিম। লকডাউনের খবর শুনেই তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। সেলিম জানান, গত বছর করোনা শুরুর পর এপ্রিল মাসে বাড়ি চলে যান তিনি। গ্রামে অন্যের ক্ষেত-খামারে কিছুদিন কাজ করে বহু কষ্টে সংসার চালাতে হয়েছে তাকে।
পেটের তাড়নায় গত তিন মাস আগে ঢাকায় ফিরে এসে সেলিম আবার রিকশা চালানো শুরু করেন। সেলিম বলেন, ‘করোনার পর থেইক্যা স্কুল-কলেজ বন্ধ। এমনিতেই খ্যাপ কম। রিকশা চালাই- শুধুমাত্র পেটটা চলে। তারমধ্যে আবার লকডাউন- কেমনে বাঁচুম আমরা! গরিব মারার জন্য লকডাউন। গরিব তো করোনায় মরে না। মরে অভাবে। বাড়ি যাবো যে, তার তো উপায় নাই। গাড়ি ভাড়ার টাকাও তো জোগাড় করতে পারবো না। বউ-বাচ্চা নিয়া আমরা চাইর জন। ভাড়া দিতে হবে আট জনের। এই টাকা কই পাবো? হাতে জমানো টাকাও নাই যে, লকডাউনে বইসা বইসা খাবো। আমরা দিনে আনি দিনে খাই।’ আরেক রিকশা চালক সুজন বলেন, ‘করোনার সময় সারা দিনে পাঁচশ টাকাও ইনকাম হয় না। আগে যেই খানে হাজার-বারশো টাকা হইতো। রিকশা জমার টাকা দিয়া হাতে যে টাকা থাকে খুব কষ্টে খাইয়া না খাইয়া বাড়িতে পাঠাই। বাড়িতে মা-বাবা, বউ-বাচ্চা রাইখ্যা আইছি। এতগুলা মানুষ আমার মুখের দিকে চাইয়া আছে। লকডাউন দিলে শুধু আমি না আমার পুরো পরিবার না খাইয়া মরবে। সরকার তো আমাদের কথা ভাবে না। তারা এই করোনার মধ্যে কোটি কোটি টাকার আতশবাজি ফুটায়, আনন্দ করে। আর লকডাউন দিয়া আমাদের গরিবের পেটে লাথি মারে।’ ভ্যানে করে এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায় মাটির হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করে মুকুল। লকডাউনের খবর জানতে পারার পর থেকেই তার মন খারাপ। মুকুল বলেন, ‘লকডাউন হইলে তো ভ্যান নিয়া আর বাহির হইতে পারবো না। দুইদিনের মধ্যে তো সব জিনিস বিক্রিও হইবো না। আল্লাহ জানে লকডাউন কতোদিন থাকবো। আমার বাড়ি নরসিংদীতে। বাড়ি যে যাবো জিনিসপত্র কই রাইখ্যা যাবো। এর আগে মার্চ মাসে বাড়িতে যাইয়্যা ছয় মাসেও আসতে পারি নাই। সরকার আরো আগে থেইকা লকডাউনের কথা জানাইতে পারতো তাহলে আমাগো মতো গরিব মানুষ অন্তত বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতো। একদিকে গাড়ি ভাড়া বাড়ায় দিছে অন্যদিকে লকডাউন- সবদিকে আমাদের মরণ। বাদাম বিক্রেতা তোফাজ্জল বলেন, ‘আইজক্যা শুনলাম সোমবার থেইকা লকডাউন। এখন তো এমনিতেও বেচাকেনা কম। তারপর লকডাউন হইলে তো ফুটপাথে বসতেও দিবো না। ঢাকায় থাইক্যা আর কি করুম। সরকার আমাদের মতো গরিবদের জন্য বেশি বাস ভাড়াটা মাফ কইরা দিতো। তাহলে আর আমাদের বাড়ি যাইতে কষ্ট হইতো না। সামনে রমজান- আল্লাহপাক ভালো জানেন আমরা কি খাইয়্যা রোজা রাখুম। ফার্মগেইট ওভার ব্রিজের নিচে ফুটপাথে কাপড় বিক্রি করে শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, গত বছর রমজানে কোনো ব্যবসা করতে পারি নাই। এই বছর আশায় ছিলাম রমজানে কিছু বেচা-বিক্রি হবে। সেইটাও হইলো না। আমার সব পুঁজি ভাইঙ্গা মাল উঠাইছি ঈদের জন্য। এখন তো লকডাউনে আর বসতেও পারবো না। রুগ্ণ জীর্ণ শরীর নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে বাসাবাড়িতে কাজ করতে এসেছে ষাটোর্ধ্ব মিরুর মা। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছে সে। সুদের টাকা জোগাড় করতেই ঢাকায় কাজ করতে আসা তার। মিরুর মা জানান, পাঁচ বাড়িতে কাজ করে ঋণের টাকা জোগাড় করতেন তিনি। এরই মধ্যে এপ্রিলের এক তারিখ থেকে দুই বাসায় কাজে মানা করে দিয়েছে তাকে। লকডাউন শুরু হলে তো কোনো বাড়িতে কাজ করতে পারবে না সে। চোখ মুছতে মুছতে মিরুর মা বলেন, ‘কাজ করতে না পারলে ঋণের টাকা কই থেইক্যা দেবো। তারচেয়ে ভালো করোনা একেবারে আমাগো মতো সব গরিবদের মাইরা ফালাইতো। এর আগে ছয় মাস বাড়িতে বইসা ছিলাম তখন কতো সুদের টাকা জইম্যা গেছে। এখন যদি আবার বাড়ি চইল্যা যাই আর ক্ষেত ছাড়াইতে পারুম না।’