রাজপরিবারে জন্ম না হলেও নেটিজেনরা তাকে অহরহ নেপালি রাজনীতির ‘স্মার্ট কুইন’ বলে অভিহিত করেন। কাঠমাণ্ডুর টালমাটাল রাজনীতিতে তার অবস্থান এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে নেপালের ‘ব্যালেন্স রিলেশন’-রক্ষার চেষ্টাতে তিনি কতটা সফল তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ২০১৭ সালের বহুল আলোচিত পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর সরকার গঠন প্রক্রিয়া বিলম্বের জন্যও তাকে দায়ী করা হয়। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির সুপারিশে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্তে বেশ বিপাকেই পড়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি। তার এই সিদ্ধান্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ওই রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ভারত ও চীনের সঙ্গে নেপালের সম্পর্কেও নতুন মাত্রা আনে। কিন্তু বিদ্যা ভান্ডারির অবস্থানে তারতম্য ঘটেছে সামান্যই। এটা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বলেই সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির প্রাজ্ঞ বিশ্লেষকরা।
নেপালি রাজনীতির সেই ‘স্মার্ট কুইন’ প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি দুু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আজ ঢাকা আসছেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালের কোনো রাষ্ট্র প্রধানের এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর যৌথ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে আসছেন তিনি। তবে সেরিমনিয়াল ওই ভিজিটে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়েও বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা হবে নেপালের প্রথম নারী প্রেসিডেন্টের। ভারত না চীন- শেষ পর্যন্ত কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে যাচ্ছে নেপাল? এই প্রশ্নে বহু দিন ধরে ফুঁসছে দক্ষিণ এশিয়ার ল্যান্ড-লক কান্ট্রি নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। বলাবলি আছে চীনের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠতা সাম্প্রতিক সময়ে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে নেপালের বর্তমান নেতৃত্ব। সেই প্রেক্ষিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে খানিকটা শীতলতা আসে নেপালের ঐতিহাসিক মিত্র ভারতের সঙ্গে। যদিও কাঠমাণ্ডুতে ভারতের উচ্চপর্যায়ের সিরিজ সফর সম্পর্কে উষ্ণতা ফেরাতে সক্ষম হয় বলে দাবি দক্ষিণ এশীয় পর্যবেক্ষকদের। তাদের মতে, নেপালের প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বর্তমান প্রেসিডেন্ট বিদ্যা ভান্ডারির আজকের অবস্থান অনেকটা চীনের কারণে। নেপালের মার্কস ও লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে একীভূত করে বেইজিং এবং তাদের মধ্যস্থতায় একীভূত নেপালি কমিউনিস্ট পার্টির জ্যেষ্ঠ সহ-সভানেত্রী বিদ্যা ভা-ারিকে প্রেসিডেন্ট করা হয়। ১৯৬১ সালের ১৯শে জুন পৃথিবীর আলো দেখা বিদ্যা ভান্ডারির রাজনীতির হাতেখড়ি ছাত্র জীবনেই। নেপালের ত্রিভূবন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ ওই নারী নেত্রী সত্তরের দশকে বাম স্টুডেন্ট ইউনিয়নে সম্পৃক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি সিপিএন (এমএল) এর যুব ফ্রন্টেও সক্রিয় ছিলেন। সেই সময়ে তিনি এএনএনএফএসইউ’র ইস্টার্ন জোন কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে তিনি ১৯৯৭ সালে সিপিএন-ইউএমএল সেন্ট্রাল কমিটিতে স্থান পান। তারও আগে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিদ্যা ভান্ডারি। তরুণ ওই নারী নেত্রী প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন দেশটির প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কৃষ্ণা প্রসাদ ভট্টারাইকে হারিয়ে। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়বার যখন তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচন করেন তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্পিকার দামানাত দুঙ্গানা। বিপুল ব্যবধানে তাকেও হারান। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দল এবং সরকারকে তার নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে। তিনি পরিবেশ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে ফোর্বসের জরিপে বিশ্বের একশ’ প্রভাবশালী নারী নেতৃত্বের তালিকার মাঝামাঝিতে স্থান করে নিতে সমর্থ হন তিনি। রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপক সফলতা উপভোগ করলেও বিদ্যা ভান্ডারির ব্যক্তিগত জীবনটা ট্র্যাজিক। ১৯৮২ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিয়ের মাত্র ১১ বছরের মাথায় তার দাম্পত্য সহযোগী মদন ভান্ডারি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। ১৯৯৩ সালে নেপালের চিতওয়ান জেলার অদূরে দাজদুঙ্গা নামক স্থানের ওই গাড়ি দুর্ঘটনাকে ‘হত্যাকা-’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও সেই মামলা এখনো তদন্তাধীন। কম বয়সে স্বামীহারা হলেও বিদ্যা ভান্ডারি দ্বিতীয় পতির পাণি গ্রহণ করেননি বিদ্যা। বর্তমানে দুই কন্যাকে নিয়েই তার সংসার।
ঢাকা সফরের কর্মসূচির বিস্তারিত: প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে ঢাকা সফরে আসা নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা ভান্ডারির কর্মসূচির বিস্তারিত প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস। প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীনকে উদ্ধৃত করে বাসস জানায়, নেপালের প্রেসিডেন্ট ও তার সফর-সঙ্গীদের বহনকারী বিমানটি সোমবার সকাল ১০টার দিকে হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের কথা। প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ বিমানবন্দরে নেপালের প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানাবেন। ২১ বার তোপধ্বনির পর বিমানবন্দরে নেপালের প্রেসিডেন্টকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। হযরত শাহজালাল (র.) বিমানবন্দর থেকে নেপালের প্রেসিডেন্ট সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। বিদ্যা দেবী সেখানে দর্শনার্থীÑবইয়ে স্বাক্ষর করবেন এবং একটি গাছের চারা রোপণ করবেন। বিকালে নেপালের প্রেসিডেন্ট সম্মানিত অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর যৌথ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন। মঙ্গলবার ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানম-ি ৩২ নম্বরস্থ স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। নেপালের প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গীদের মধ্যে- পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী প্রদীপ কুমার গিয়াওয়ালি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রেসিডেন্টের অফিস, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সিনিয়র কর্মকর্তারা রয়েছেন।
যা থাকছে নেপালি প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে নেপালি প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকে দুই দেশের জনগণের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতিফলন বলে উল্লেখ করেন। মন্ত্রী জানান, জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর যৌথ উদযাপন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করা ছাড়াও সফরকালে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক হবে তার। বঙ্গভবনে অতিথির সম্মানে একটি রাষ্ট্রীয় ভোজ আয়োজন করছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। সেখানে দুই প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে বেশক’টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের সঙ্গে এ নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত সমঝোতা স্মারক সমূহ স্বাক্ষরিত হলে দুই দেশের মধ্যে পর্যটন খাত, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হবে।

