করোনার কারণে টানা এক বছর ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ ঘোষণা করেছিল সরকার। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাই নড়েচড়ে বসেছিলেন। তবে সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরাও উদ্বিগ্ন।
দেশে করোনা সংক্রমণের হার ৩ শতাংশের নিচে নেমে আসায় সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ইতোমধ্যে সংক্রমণ ফের ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এক দিনের ব্যবধানে কেবল গতকাল সোমবার নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৭৭৩ জন। মারা গেছেন সর্বোচ্চ ২৬ জন। এটি গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত ও মৃত্যু। সারাদেশের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মাঝেও গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ১৭ মার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত জানুয়ারি থেকে সংক্রমণ কমতে থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন- করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুহার এভাবে বাড়তে থাকলে ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
পরিস্থিতির দিকে তীক্ষষ্ট নজর রাখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে তার আগে ছাত্র-শিক্ষকদের টিকাদান কার্যক্রম নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে নতুন পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে নীতি-নির্ধারকদের। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত শুক্রবার বলেছেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম রোববার বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এখন কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে বড় বিপদের শঙ্কা রয়েছে। এখন আক্রান্ত হচ্ছেন বেশিরভাগই তরুণ।
সবাইকে সতর্ক করে এই মহাপরিচালক বলেন, গেল দুই মাস আমরা স্বস্তিতে ছিলাম, তাই এখন আমরা কোনো কিছু মানছি না। সামনের দিকে আমরা আরও বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছি যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মানি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, ‘নিশ্চিতভাবেই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সরকারের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে করোনা সংক্রমণের হার, পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে যথাসময়ে সরকার যথা সিদ্ধান্ত নেবে।’
মাঠ পর্যায়ের তথ্য নিচ্ছে মাউশি:মাউশি সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হবে কি হবে না- সে বিষয়ে মাউশি মাঠ পর্যায়ের তথ্য নিতে শুরু করেছে। সারাদেশে মাউশির নয়টি অঞ্চলের ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের আঞ্চলিক উপপরিচালকের কাছে এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের চিত্র ও মতামত গত সপ্তাহে চাওয়া হয়েছিল। গতকাল সোমবার পর্যন্ত আটটি অঞ্চলের মতামত মাউশিতে এসে পৌঁছেছে। এসব মতামতে ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার পক্ষে ও বিপক্ষে দুই ধরনের মতামতই এসেছে। তবে বেশিরভাগ উপপরিচালক তার অঞ্চলের স্কুলগুলোর চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, এ মুহূর্তে বিদ্যালয় খুলে দিলে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই কোনো সমস্যা নেই। কোনো কোনো উপপরিচালক তার অঞ্চলের ছাত্রাবাস থাকা বিদ্যালয়গুলোর চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, করোনা সংক্রমণ বাড়ার মুখে এসব স্থানে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানা আদৌ সম্ভব হবে না। কোনো ছাত্রাবাসে ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীও রয়েছে। ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের ক্ষেত্রে সরকারি যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা নিতে হবে।
মাউশির একজন উপপরিচালক জানান, মাঠ পর্যায়ের প্রাপ্ত মতামত তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ই নেবে।
খোলার সিদ্ধান্ত রিভিউ দাবি অভিভাবকদের: করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ার কারণে দেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি পর্যায়ের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত রিভিউ করার দাবি জানিয়েছে অভিভাবক ফোরাম।
গতকাল সোমবার ফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু ও সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম উদ্দিন এক যুক্ত বিবৃতিতে এ দাবি জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণ ৩ শতাংশের নিচে কমে আসায় সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ৩০ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার ঘোষণা আসে। কিন্তু ইতোমধ্যে সংক্রমণ ফের ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। ঘোষিত তারিখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করেছে। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ও পাশাপাশি নতুন বা পরিবর্তিত রূপের আবির্ভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
এতে আরও বলা হয়, শহরাঞ্চলে বেশিরভাগ অভিভাবককে সন্তান নিয়ে গণপরিবহন বা রিকশায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতে হয়। যুবকদের আক্রান্তে হার আগের চেয়ে বেড়েছে। শিশুদের হার কম হলেও তারা ভাইরাস বাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। এ অবস্থায় অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন না।
অভিভাবক নেতারা বলেন- আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী এবং অভিভাবকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই নতুনভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। জাতীয় পরামর্শ কমিটির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সরকারকে স্কুল-কলেজ খোলার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানাচ্ছি।