টার্গেট বিত্তশালী। নিজের রূপ যৌবনে আকৃষ্ট করে কাছে টানা। এরপর অর্থ-সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। এমনকি হ্যান্ডসাম কম বয়সী ছেলেদের ভাড়া করে নেন। মেতে ওঠেন উন্মাদনায়। একে একে তিনটি বিয়ে করে হাতিয়ে নিয়েছেন অর্থ-বিত্ত। স্বার্থ হাসিল হলেই ডিভোর্স। তারপর আবার মাঠে নামে নতুন শিকারের খোঁজে।
এমনকি বিত্তশালীকে বাসায় ডেকে অচেতন করে ধারণ করেন নগ্ন ছবি। ওই ছবি দিয়েই ব্ল্যাকমেইল করেন। এমন নানা অভিযোগ উঠেছে টিভি অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্রের নায়িকা রোমানা ইসলাম স্বর্ণার বিরুদ্ধে। প্রতারণার অভিযোগে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে স্বর্ণা ও তার ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে আন্নাফি এবং স্বর্ণার মা আশরাফী আক্তার শেইলীকে। গতকাল জেলগেটে একদিনের জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত।
জানা গেছে, একটি রিয়েলিটি শোর মাধ্যমে শোবিজ জগতে মুখ দেখান স্বর্ণা। তিনি ফরিদপুর জেলা সদরের দক্ষিণ টেপাখোলার এটিএম নজরুল ইসলামের মেয়ে। নিজের রূপ-যৌবনে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিলেন। তার রমণীয় আহলাদে সাড়া দিচ্ছিলেন এক শ্রেণির বিত্তশালীরা। নাটক, ফিল্ম, শর্টফিল্মে নিজেকে উপস্থাপন করে বাড়াচ্ছিলেন চাহিদা। একান্তে সময় দিতে গুলশানের লেক সংলগ্ন একটি পাঁচতারকা হোটেল ও কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকার ডিকে ইন্টার ন্যাশনাল হোটেলে ছিল আসা-যাওয়া। ধনাঢ্যদের সঙ্গী হিসেবে রাতের পর রাত এই দুটি হোটেলে কাটিয়েছেন স্বর্ণা। কলকাতায় ও ঢাকায় একশ্রেণির বিত্তশালীদের সঙ্গে রয়েছে তার অন্তঃরঙ্গ সম্পর্ক। এ ছাড়াও নিকেতনের একটি ফ্ল্যাটে ছিল নিয়মিত আড্ডা। প্রভাবশালী কয়েক নেতাও রয়েছেন এই তালিকায়। অল্পদিনেই বিপুল অর্থের মালিক হতে বিত্তশালীদের সঙ্গী হতেন তিনি। এই পথের বাধা হিসেবে ২০১৭ সালে নিজ এলাকার ছেলে তানভীর ইউসুফকে ডিভোর্স দেন এক সন্তানের জননী স্বর্ণা। বিয়ে করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন এক আইনজীবীর। এসবই ঘটছিলো আড়ালে। কথিত রয়েছে বিয়ে করেছিলেন আরেক ট্রাভেল এজেন্সির মালিককেও। যদিও স্বর্ণা এটি স্বীকার করেননি কখনো। সর্বশেষ মাদারীপুরের রাজৈর’র শ্রীকৃষ্ণদি গ্রামের আব্দুল মান্নান মাতুব্বরের পুত্র সৌদি প্রবাসী কামরুল হাসানকে বিয়ে করেন তিনি। ধনাঢ্য কামরুল অভিযোগ করেছেন, বিয়ে, ব্ল্যাকমেইল স্বর্ণার পেশা। ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ-বিত্ত হাতিয়ে নেন এই অভিনেত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা।
সৌদির রাবিয়াহ আল-মদিনা ইলেকট্রো মেকানিক্যাল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মিরপুরের কেএম জুয়েল ইন্টান্যাশনাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ৪৫ বছর বয়সী কামরুল। ২০১৮ সালে ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরবরে স্বর্ণার সঙ্গে পরিচয়। নিজেকে অভিনেত্রী ও বিধবা হিসেবে পরিচয় দেন। অল্প সময়ের পরিচয়েই কামরুল হাসানকে যোগাযোগ রাখার অনুরোধ করে ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠাতে বলেন। সেই থেকেই শুরু। রিকোয়েস্ট পাঠানোর পর থেকেই শুরু হয় বন্ধুত্বতা। কারণে অকারণে কথোপকথন, চ্যাটিং, কল। নিজের রূপ-সৌন্দর্যকে উপস্থাপন করতে পাঠাতেন নানা এঙ্গেলের ছবি। জানতে চাইতেন, ছবিতে কেমন দেখাচ্ছে তাকে।
এ বিষয়ে দায়েরকৃত মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে কখনো ছেলেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, কখনো বিধবা হিসেবে আর্থিক দৈন্যতার বিষয় প্রকাশ করে সহযোগিতা চাইতেন। একপর্যায়ে স্বর্ণা তার দৈন্যতার কথা জানিয়ে উবারে গাড়ি চালানোর জন্য একটি গাড়ি কিনতে চান বলে কামরুলকে জানান। গাড়ি কেনার জন্য ধার হিসেবে টাকা চান তিনি।
মামলার বাদী কামরুল জানান, সরল মনে স্বর্ণার কথা বিশ্বাস করে ২০১৮ সালের নভেম্বরে কয়েক দফায় ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন তিনি। ওই টাকা দিয়ে কালো রঙের একটি প্রিমিও প্রাইভেটকার ক্রয় করেন রোমানা ইসলাম স্বর্ণা। এরমধ্যেই নতুন গল্পের প্লট তৈরি করেন এই অভিনেত্রী। কামরুলকে জানান, লালমাটিয়ার সি ব্লকে একটি ফ্ল্যাট বিক্রি হবে। স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ জোগাতে ফ্ল্যাটটি বিক্রি করতে চান এর মালিক। স্বর্ণার কাছে টাকা নেই। প্রস্তাব দেন আপাতত এটি কামরুল ইসলামের নামে কিনে রাখতে চান। এজন্য প্রয়োজন এক কোটি টাকা। ফ্ল্যাটটি পরে বিক্রি করে লাভ করা যাবে। লভ্যাংশের এক তৃতীয়াংশ দাবি করেন স্বর্ণা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত আত্মীয়-বন্ধুদের মাধ্যমে নগদ এবং রোমানা স্বর্ণা, তার ভাই নাহিদ হাসান রেমি এবং মা আশরাফী আক্তার শেইলীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ৬৬ লাখ ৮ হাজার টাকা দেন কামরুল।
২০১৯ সালের ১৩ই মার্চ কামরুলকে বাসায় ডাকেন স্বর্ণা। পরদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় লালমাটিয়ার সি ব্লকের ১/১ নম্বর বাড়ির বি/৩ নম্বর ফ্ল্যাটে ঘটে ভয়ঙ্কর ঘটনা। বাসায় তখন স্বর্ণা ও তার ভাই রেমি, ভাইয়ের স্ত্রী ফারহা, মা আশরাফী, ছেলে আন্নাফি উপস্থিত ছিল। মামলার এজাহারে কামরুল উল্লেখ করেছেন, ‘পরিচয় পর্ব শেষে বিভিন্ন ফলমূলসহ নাশতা পরিবেশন করে। নাশতা খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। একপর্যায়ে আমি নিজেকে ওই ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় আবিষ্কার করি। এ সময় আমি চিৎকার করলে রোমানা স্বর্ণা, তার ভাই ও অজ্ঞাত এক যুবক ওই রুমে প্রবেশ করে। এ সময় স্বর্ণা তার মোবাইলফোনে আমার ও তার পাশাপাশি শুয়ে থাকা অর্ধউলঙ্গ কয়েকটি ছবি দেখিয়ে বলে, চিল্লাচিল্লি করবি না। গাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনা বাবদ যে টাকা দিছিস তা ভুলে যা। আমাকে বিয়ে করতে হবে। নতুবা দেশে-বিদেশে তোর পরিচিতদের কাছে ছবি পাঠিয়ে তোর মান-সম্মান সব নষ্ট করে দেবো। তোর নামে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা করবো।’ এভাবেই ওই প্রবাসীকে হুমকি দেন স্বর্ণা।
ওই সময়ে জোর করে স্বর্ণার পরিবারের সবাই মিলে স্ট্যাম্পে দস্তখত নিতে চেষ্টা করে। বাধা দিলে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেন কামরুল। বাধ্য হয়ে এতে স্বাক্ষর করেন। ধর্ষণ মামলা ও সামাজিক মর্যাদাহানির ভয় দেখিয়ে সাতদিনের মধ্যে স্বর্ণাকে বিয়ে করার হুমকি দেয়া হয় এ সময়। বাধ্য হয়ে ওই বছরের ২০শে মার্চ স্বর্ণাকে বিয়ে করেন কামরুল।
দেনমোহর হিসেবে নগদ ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করেন তিনি। সেইসঙ্গে দেন ৩৩ ভরি স্বর্ণ। বিয়ের পর চার লাখ টাকা মূল্যের বালম্যান ব্র্যান্ডের হাতঘড়ি, প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের দুটি আইফোন আদায় করেন কামরুলের কাছ থেকে। ওই বছরের ৬ই এপ্রিল আবার সৌদি চলে যান কামরুল। চার-পাঁচ মাস পরে দেশে ফিরলে দেখতে পান আমূল বদলে গেছেন রোমানা স্বর্ণা। কামরুলের সঙ্গে দেখাই করতে চান না তিনি। এমনকি তার সঙ্গে সংসার করবেন না বলে জানিয়ে দেন। এবার নিজের দেয়া টাকা ও স্বর্ণালংকার ফেরত চান কামরুল। স্বর্ণা তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। নিরুপায় হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। ২০২০ সালের ৬ই জানুয়ারি প্রতারণার অভিযোগে একটি মামলা করেন। স্বর্ণা ও তার পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন আদালত। এবারো কৌশল অবলম্বন করেন স্বর্ণা। টাকা ও স্বর্ণ ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ওই বছরের ১লা মার্চ মামলা প্রত্যাহার করেন কামরুল।
এবারো অভিনয়ের জালে আবদ্ধ করেন কামরুলকে। ভালোবাসার অভিনয় করে আরো ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন এই অভিনেত্রী। আগের গাড়িটি বিক্রি করে কিনেন টয়োটা সিএইচআর গাড়ি। বিভিন্ন অজুহাতে হাতিয়ে নেন আরো নগদ প্রায় ২০ লাখ টাকা ও ৮ ভরি স্বর্ণ। এরমধ্যে আবার দেশের বাইরে চলে যান কামরুল। গত ১২ই ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরেন। স্বর্ণাকে ফোনে পান না। লালমাটিয়ার বাসাতেও নেই। একবার ফোন রিসিভ করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন স্বর্ণা। স্বর্ণা তখন গুলশানের তারকা হোটেলে। ওই দিন রাত প্রায় ৩টায় বাসায় ফিরেন স্বর্ণা। জানানো হয়, কামরুলকে তালাক দিয়েছেন তিনি। যদিও এর কোনো নোটিশ নেই সিটি করপোরেশনের কাছে। কামরুল অভিযোগ করেন, নগ্ন ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল, বিয়ে করে অর্থ আত্মসাৎ তার পেশা। এ বিষয়ে সঠিক বিচার চান তিনি। মোহাম্মদপুর থানার ওসি আব্দুল লতিফ জানান, নানা অজুহাতে কামরুলের কাছ থেকে এক কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন স্বর্ণা। স্বর্ণা ও তার ছেলে এবং মাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বর্ণার পাঁচদিনের রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত একদিনের জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, তন্ময় তানসেনের রানআউট ফিল্মে অভিনয়সহ বিভিন্ন নাটক, বিজ্ঞাপন ও শর্টফিল্মে অভিনয় করেছেন স্বর্ণা।