চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে পর্দার আড়ালে নানামুখী তৎপরতা চলছে। হার্ডলাইন তো আছেই। খালেদাও তার অবস্থানে অনড়। একচুলও নড়বেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান তো সবার জানা। তিনি এটাকে রাজনৈতিক সঙ্কট মানতেই নারাজ। তার পরামর্শকরা ক্রমাগতভাবে বলে চলেছেন ডা-া মেরে সব ঠা-া করা সম্ভব। আর ক’টা দিন সবুর করেন। বিএনপি-জামায়াত ক্লান্ত হয়ে পড়বে। রাজপথে ওদের কোন লোকই থাকবে না। পেট্রলবোমা মারার লোকও হারিকেন দিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। জনবোমার কথা অবশ্য তারা বলছেন না। তাদের কথায়, জনগণ নীরব দর্শক হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে। জনগণ বাড়িতে বসে কি ভাবছে এটা তাদের কাছে পৌঁছবে না। একদল আছেন তারা সারাক্ষণই বলছেন নেত্রী সব ঠিক, উদারতা দেখিয়ে আপনি তো খালেদার কার্যালয় পর্যন্ত গিয়েছিলেন অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে। কি লাভ হলো। ওরা তো আপনাকে কোন সম্মানই দেয়নি। জনমনে প্রতিক্রিয়া ছিল সাময়িক। যারা আপনাকে সেখানে যেতে বলেছিল তাদের উদ্দেশ্য কি তা ভেবে দেখতে হবে। এক পর্যায়ে এই গ্রুপ সামনে চলে আসে। তারা কোকোর দাফন বনানীর সামরিক গোরস্তানে না করার পরামর্শ দেয়। যথারীতি তাদের কথামত সিদ্ধান্ত হয়। এতে কি হলো? প্রধানমন্ত্রী খালেদাকে দেখতে গিয়ে যেটুকু উদারতা দেখিয়েছিলেন তা নিমিষেই হারিয়ে গেল। তখন জনমনে প্রশ্ন উঠলো, এটা কি তাহলে লোক দেখানো ছিল? এরপর কি ঘটলো। খালেদার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। যেখান থেকে খালেদা এখন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলো দেশ-বিদেশে। এক পর্যায়ে চাপের কারণে ১৯ ঘণ্টা পরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হলো। লাভের মধ্যে লাভ এটাই হলো, বাংলাদেশে একটা খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো হাসিনার সরকার। এখনও খালেদার কার্যালয়ে ডিশ নেই। ইন্টারনেট নেই। মোবাইল কানেকশনও নেই। টিঅ্যান্ডটি সংযোগও নীরব। হার্ডলাইনাররা খালেদাকে গ্রেপ্তারের যুক্তি দিয়ে চলেছেন। তারা বলছেন, তাকে গ্রেপ্তার করা হলে সব নীরব হয়ে যাবে। মানুষ রাজপথে নেমে যাবে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে নিমিষেই। শনিবার বসলো এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। যেখানে হাজির উচ্চ পর্যায়ের সব প্রশাসনিক কর্মকর্তা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষে বল প্রয়োগের মাধ্যমে সঙ্কটের সমাধান খোঁজার পক্ষে সবাই একমত হলেন। কিন্তু যারা ভিন্নমত পোষণ করেছেন তারা একমত হলেন না। তারা বলতে থাকলেন সঙ্কট যেহেতু রাজনৈতিক তাই সমাধানও রাজনৈতিকভাবে খুঁজতে হবে। এদের ভয়েস অবশ্য দুর্বল। ভয়ে ভয়ে তারা আওয়াজ তুলেছেন। এর মধ্যেই পাশের বাড়ি থেকে পরামর্শ এসেছে। যে করেই হোক খালেদার সঙ্গে এনগেজমেন্টে যেতে। খবরটা আচমকা মনে হলেও ঠিক তা নয়। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেই জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ অস্থিতিশীল থাকুক তার সরকার তা চায় না। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান দিল্লিতে। বোঝানোর চেষ্টা করেন বাংলাদেশ পরিস্থিতি। যতটুকু জানা যায়, প্রণব জানিয়ে দেন তার কিছুই করার নেই। মোদি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তারা চায় বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পক্ষে তারা। এ খবরে সরকারের ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। দিল্লি ছুটে যান দু’জন উপদেষ্টা। ফলাফল একই। এর মধ্যে বারাক ওবামার সফর সবকিছু পাল্টে দেয়। সুজাতা সিং চাকরি হারান। যিনি রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে রীতিমতো অপমান করেছিলেন দিল্লিতে। মজিনা তাকে বোঝাতে গিয়েছিলেন সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে স্থিতি আসবে না। এই যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে সুজাতা তাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশ নিয়ে নাক গলাচ্ছে। মজিনা হতাশ হয়েই ঢাকা ফিরেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানিয়ে দেন ভারতের মনোভাব। কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে একচোখা নীতি গ্রহণ করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারও ছিল কংগ্রেসের ব্যাপারে অন্ধ। বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে এটাও তাদের ভাবনার মধ্যে ছিল না। নির্বাচনের সময় কংগ্রেসের প্রতি এমনভাবে হাত বাড়িয়ে দেয় যা শুনে মোদি রীতিমতো তাজ্জব হয়ে যান। থাক গে, ওসব অতীত। সুজাতাকে বরখাস্ত করে জয়শঙ্করকে পররাষ্ট্র সচিব নিযুক্তির পরে বাংলাদেশ অনেকটাই ভেঙে পড়ে। তাকে অভিনন্দন জানাতে কূটনৈতিক রীতিও অনুসরণ করেনি। পর্দার আড়ালে আসলে কি হচ্ছে? সংলাপ না আলোচনা? নানা কথাই শোনা যাচ্ছে। অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করবেন না এক ধরনের যোগাযোগ চলছে দুইদিকে। কিভাবে সেটা। অনেকেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া, মোসাদ্দেক আলী ফালুর গ্রেপ্তারের মধ্যে মিল খুঁজে পাচ্ছেন। তারা বলছেন, ফালু জেনেশুনে খালেদার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন কেন? তিনি কি জানেন না ওখানে গেলেই শ্রীঘরে যেতে হয়। অনেকটা নাটকীয়ভাবে মির্জা ফখরুলকে কাশিমপুর থেকে ডিবি অফিসে আনা হলো কেন? রাজনৈতিক যোগাযোগ আগেও এভাবে হয়েছে। প্রস্তাবটা কি? দুই পক্ষের মুখরক্ষা করে সমাধানের সূত্রইবা কি? জরুরি অবস্থা জারি করে আলোচনা। এতেও ভরসা নেই শাসককুলের। তারা জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে নন। তারা মনে করেন, এতে খেলাটা তাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই সম্ভবত দশ দিন আগে জরুরি শাসনের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা বাতিল করে দেয়া হয়। প্রকাশ্য আলোচনার প্রস্তাবেও ঝুঁকি রয়েছে। মানুষ রাজপথে নেমে যাবে। কোকোর জানাজার সময় গুলি হবে না- এমনটা আঁচ করে লাখো লোক জমায়েত হয়েছিল। এটাও পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে। জবাব মিলেছে নেতিবাচক। বরং এমন গোয়েন্দা রিপোর্টের সমালোচনা হচ্ছে শাসক দলের বিভিন্ন কোরামে। বিএনপি অগোছালো, জামায়াত ম্যানেজ হয়ে আছে এমন রিপোর্টই তারা দিয়েছিলেন। যার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রায়শই বলতেন, বিএনপির আন্দোলন করার মুরোদ নেই। খালেদার জনসভাগুলোতে জনসমাগম দেখে অন্য চিন্তা আসে সরকারের ভেতর। গাজীপুরের জনসভা বাতিল করার সিদ্ধান্ত এসেছিল গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়িতে। ক্রমশ বলাবলি হচ্ছে, জনসভা করতে দিলে এতটা হতো না। ৪ঠা জানুয়ারি সরকারইবা কেন অবরোধ করতে গেল। খালেদাকে ৫ জানুয়ারি জনসভা করতে দিলে তিনি কি করতেন? বসে যেতেন লোকজন নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা বলেন, এমন কোন পরিকল্পনাই ছিল না তাদের। তাহলে প্রধানমন্ত্রী কিসের ওপর ভিত্তি করে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? তাহলে কি বলা যায়, খালেদা ক্ষমতায় থাকাকালে শেষদিকে যে পথে হেঁটেছিলেন সে পথেই তিনি হাঁটতে শুরু করেছেন?