যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেন নির্বাচনের আগে বৈদেশিক নীতি বিষয়ে যেসব সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলোর অন্যতম একটি ছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রথম বছরেই তিনি ‘বিশ্ব গণতন্ত্র সম্মেলন’-এর আয়োজন করবেন। ডনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানের বিরুদ্ধে খোলামেলা অবস্থান গ্রহণই এই সমাবেশের উদ্দেশ্য। কেননা, বাইডেন এবং তার পরামর্শদাতারা মনে করেন, দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন পশ্চিমা রাজনৈতিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দেয়ার হুমকি দিচ্ছে।
জো বাইডেন গত বছরের মার্চ মাসে ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন, ‘দেশে দেশে গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি তীব্র মতবিরোধের কারণে সৃষ্ট মেরুকরণ ও দুর্নীতির কবলে পড়ে এবং চরম বৈষম্যের দ্বারা পঙ্গু হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও মানুষের আস্থা কমছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি যুক্তরাষ্ট্র এবং আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের গণতন্ত্রের স্বার্থে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। কেননা, ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের ওপর গণতন্ত্র এবং উদারপন্থার জয়ই মুক্ত বিশ্বের সূচনা করেছিল। আমি বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বৈশ্বিক এজেন্ডায় আবারো ‘গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে ফেরা’কে আমন্ত্রণ জানাবো। অফিসে আমার প্রথম বছরেই যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত বিশ্বের দেশগুলোর চেতনা ও অভিন্ন উদ্দেশ্য নতুনভাবে শুরু করতে গণতন্ত্রের জন্য একটি বৈশ্বিক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করবে।
এটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে একত্রিত করবে।’
এ সম্মেলন নিয়ে নিজের নির্বাচনী ইশতেহারেও বাইডেন অনেক কিছু বলেছেন, যার মধ্যে তিনটি ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো: স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করা ও কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার প্রতিরোধ করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সকল দেশে মানবাধিকার নিশ্চিত করা। এ ছাড়াও সব দেশের সুশীল সমাজের সঙ্গে পার্টনারশিপ তৈরি করার কথাও বলা হয়েছিল। ইদানীং অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন ইত্যাদি) গণতন্ত্রের পথে যেন বাধা হয়ে না উঠতে পারে সেটি নিশ্চিত করা।
এ বিষয়ে গত বছরের শেষের দিকে প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নীতি পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক পরিচালক অ্যান মারি স্লটার এবং বেসরকারি সংস্থা নিউ আমেরিকার জ্যেষ্ঠ গবেষক আলেকসান্দ্রা স্টার্ক যুক্তি দেখিয়ে লিখেন, ‘(নির্বাচনে) ভোট ব্যবস্থার মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনে (যুক্তরাষ্ট্রকে) আরো বেশি বিনিয়োগ করতে হবে এবং বাইরের যেসব দেশে গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে পড়ছে, সেসব দেশের গণতন্ত্রের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
নির্বাচনী প্রচারের সময়জুড়ে এবং ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই বাইডেন জানিয়ে আসছেন যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নিজের প্রথম বছরে গণতন্ত্র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এই আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলনটির আয়োজন করা হবে। কিন্তু সেটি এই বছরের ঠিক কোন্ সময়ে অনুষ্ঠিত হবে তাই নিয়ে যেন সবাই দিন গুনছিলেন।
অবশেষে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এ রহস্য খোলাসা করেছেন। বৃহস্পতিবার তাইওয়ান নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভস- এর পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি বুধবার বাইডেনের বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকার নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটি শুনানিতে ব্লিনকেনকে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে অংশ নিয়ে ব্লিনকেন ইঙ্গিত দেন, এ বছরের শেষের দিকে ওই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে। তিনি জানান, ওই সম্মেলন বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো সম্মিলিতভাবে বুঝতে এবং একে অপরের কাছ থেকে শিখতে সমমনা মিত্রদের একত্রিত করার কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রে তাইওয়ানের দূত শাও বি-খিম বলেছেন, তিনি একাধিক উপলক্ষে বাইডেন প্রশাসনের কাছে জানিয়েছেন ওই শীর্ষ সম্মেলনে তাইওয়ান অংশ নেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তিনি জানান, এ বিষয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন।
তাইওয়ান নিউজের প্রতিবেদনেও বলা হয়, ব্লিনকেন বুধবার জানিয়েছেন, তিনি তাইওয়ানকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাবেন।
বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই প্রথম এমন আয়োজন করলেও দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বৃহত্তর অর্থে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের পক্ষের লোক। ২০১৮ সালে তিনি কোপেনহেগেন গণতন্ত্র সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন। সেখানে তিনি পপুলিজম (পপুলিজম বা লোকরঞ্জনবাদ জনগণের আবেগ, বঞ্চনা, হতাশা ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে তাদেরকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখায়)-এর হুমকি এবং কারণ সম্পর্কে আলোচনা করেন।