শনিবার সকাল ১১টা। রাজধানীর মালিবাগ এলাকা। যাত্রাবাড়ীগামী তুরাগ বাসের সব আসনে যাত্রী ভরা। কয়েকশ’গজ এগিয়ে গেলে বাসটিতে আট-দশজন যাত্রী ওঠে। সেখান থেকে আরেকটু সামনে গেলেই মালিবাগ বাস স্টপেজ। আগেই আসন অতিরিক্ত দশজন যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার স্টপেজ থেকে আরো কমপক্ষে ১০-১২জন যোগ হলো। এবার বাসে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
বাসে ওঠা অধিকাংশ যাত্রীর মুখে নেই মাস্ক। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে বাসে ওঠার আগে স্যানিটাইজার দেয়ার কথা ছিল। সে দৃশ্যও ছিল অনুপস্থিত। আর বাসের ফটকে মাস্ক পরে যাত্রীদের যাতায়াত করার নির্দেশনা থাকলেও তা ছিল না বলেই চলে। এমন দৃশ্য শুধু বাসেই নয়। হাট-বাজার, শপিংমল, সড়ক কোথাও নেই স্বাস্থ্যবিধি। গত বছর জুন মাস থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু চালু করার নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু প্রথম এক মাস সরকারি নির্দেশনা কিছুটা মানলেও পরবর্তীতে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। করোনা নিয়ে মানুষের ভেতর যে আতঙ্ক ছিল তা অনেকটা উধাও হয়ে যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় স্বাস্থ্যবিধি। তবে মানুষের এই স্বাভাবিক জীবন-যাপন বড় হুমকির কারণ বলেই মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শনাক্তের সংখ্যা কমে যাওয়া মানেই করোনা শেষ হয়ে যাওয়া নয়।
গত কয়েকদিনে ঢাকার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের চলাচল করোনা পূর্ববর্তী সময়ের মতোই স্বাভাবিক। হাটবাজারে গেলেই এ দৃশ্য আরো ভয়াবহ। খুব কম সংখ্যক মানুষই মুখে মাস্ক ব্যবহার করছেন। কাওরান বাজার এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, বাজারে কেনাকাটা করতে আসা অনেকেই ঘেঁষাঘেঁষি করে অবস্থান করছেন। মুখে মাস্ক নেই। নেই সামাজিক দূরত্বের বালাই। বিক্রেতাদের মধ্যেও নেই সচেতনতা। মাহফুজ নামের এক সবজি বিক্রেতাকে মাস্ক নেই কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘করোনাই তো নাই। মাস্ক পইরা কি হবে। কাওরান বাজারে ডাব বিক্রি করছেন এক তরুণ। কিছুক্ষণ অবস্থান করে দেখা যায়, তিনি পাশে থাকা আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী বন্ধুকে আড্ডাচ্ছলে জড়িয়ে ধরছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কথা বলায় সবুজ নামের এই তরুণ অট্টহাসি দিয়ে বললেন, করোনা কই। বাজারে কেনাকাটা করতে আসা ফারুক হোসেন বলেন, আসলে করোনাভাইরাস এখন কমে গেছে। সেজন্য ভয় কমে গেছে। আর হয়ে গেলে আল্লাহ্ রক্ষা করবেন। ভয় পেয়ে কি ঘরে বসে থাকবো?
এদিকে করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতেও মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চিত্র দেখা যায়নি। সবাই একে- অন্যের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে চলাচল করতে দেখা গেছে। এমনকি বেশির ভাগ মানুষ মাস্ক ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছেন।
রাজধানীর গণপরিবহনের চিত্র সবচেয়ে ভয়াবহ। আসন অতিরিক্ত মানুষ ঠাসাঠাসি করে যাতায়াত করছেন। বাসচালকের সহকারীরাও তাতে কোনো বাধা দিচ্ছেন না। বরং অতিরিক্ত মুনাফার আশায় বেশি যাত্রী বহন করে বেশ খোশ মেজাজে রয়েছেন সবাই। শাহবাগ বাসস্ট্যান্ডে মিরপুরগামী শিকড় পরিবহন নামের একটি বাসে যাত্রী পরিপূর্ণ। এমন সময় যাত্রীরাও চালককে বাস ছাড়ার জন্য জোর দেন। কিন্তু আরো যাত্রী ওঠানোর জন্য বাসটি থামিয়ে রাখা হয়। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বাসে মাস্ক ছাড়া কেউ চলাচল করতে পারবেন না এমনটা লেখা থাকলেও তা মানা হয়নি। অনেক যাত্রীর মুখে ছিল না মাস্ক। আবার ওঠার সময় যাত্রীদের স্যানিটাইজার দেয়ার কথা থাকলেও তা ছিল না। চালকের সহকারী ফরিদ বলেন, এগুলা তো আমরা জানি না। মালিক আগে স্যানিটাইজার দিতেন, এখন দেয় না। আর এখন নাকি করোনা শেষ হয়ে গেছে। তাই মানুষও চায় না।
করোনা সংক্রমণের কারণে সভা- সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা পুরোপুরি উঠে গেছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের এলাকা, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় নানা সংগঠনের সভা-সমাবেশ হচ্ছে নিয়মিত।
রাজধানীর কয়েকটি শপিং মল ঘুরে দেখা যায়, বাইরের ফটকে নির্দেশনা অনুযায়ী মাস্ক পরে ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করে ভেতরে প্রবেশ করছেন ক্রেতারা। কিন্তু ভেতরে ঢুলকেই দৃশ্য বদলে যায়। অনেকেরই মাস্ক নেমে যায় থুতনির নিচে। এমনও দেখা গেছে, ছোট একটি দোকানে ছয় থেকে সাতজন পর্যন্ত ক্রেতা ভিড় করছেন। যেখানে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই।
শনাক্তের সংখ্যা কমে গেলেও করোনা শেষ হয়ে গেছে- এমনটা ভাবা ভুল মনে করছেন বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এবিএম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, মানুষ সভা- সমাবেশ, হাট-বাজারে যেভাবে চলাফেরা করছেন তা মোটেও ঠিক নয়। জনসমাবেশও করছেন অনেকে। সবমিলিয়ে সবার মধ্যে ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে। যা সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, একবার করোনা হয়েছে কিংবা টিকা নিয়েছেন বলে নিরাপদ হয়ে গেছেন- তাও ভাবা ঠিক নয়। টিকা নেয়ার পরও করোনা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশে প্রচুর আক্রান্ত হচ্ছে করোনায়। এসব দেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত সবার।