ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠন ও নাগরিক সমাজের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এই আইনটিতে কিছু পরিবর্তন আনার কথা বলেছে। তবে তীব্র সমালোচনা করেছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এটা মতপ্রকাশ বা বাকস্বাধীনতা খর্ব করছে এবং গণমাধ্যমের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ আইন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করছে বিধায় অবিলম্বে তা বাতিল করা প্রয়োজন। আইনজ্ঞরা বলেন, এই আইনের একমাত্র উদ্দেশ্য মতপ্রকাশ বা বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা। এ আইনে অভিযোগ এলেই পুলিশ মামলা নিয়ে সাথে সাথেই অভিযুক্তকে আটক করছে। এই আইনের কারণে গণমাধ্যমের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
আইনবিদরা আরো বলেন, ভাবমূর্তি হানি বা ক্ষুণ্ণ করা বা অপমান করার জন্য দুনিয়ার কোথাও আইন নেই। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার কারণে অপরাধ হয়, এটা নাই। এটা গণতান্ত্রিক পৃথিবীতে নেই। তারা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৯ ও ৩০ এই পাঁচটি ধারা অবিলম্বে বিলোপ করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে সেই আইনে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া সংক্রান্ত ধারা থাকতে পারে না। তা হলে সেই আইনের অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার হতে বাধ্য।
এ বিষয়ে প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, আইনমন্ত্রী বলেছেন এখন থেকে তদন্ত করে ডিজিটাল আইনে মামলা করা হবে। এতদিন ধরে ডিজিটাল আইনে ঢালাওভাবে সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করা হয়েছে। এমনকি এই আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন, তার দায়ভার কে নেবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থী। গণমাধ্যমের হুমকিস্বরূপ। তাই আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করছে বিধায় অবিলম্বে এই কালো আইন বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। রাজপথে এই আইন বাতিলের জন্য যারা দাবি জানাচ্ছেন তাদেরকে সমর্থন জানাচ্ছি।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, আইন তো জনগণের জন্যই। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সংশোধন প্রয়োজন। এমনভাবে এই পরিবর্তন আনতে হবে যাতে রাষ্ট্রের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা যায়। কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ না করা হয় সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।
আইন ও সংবিধান বিশেজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক নয়া দিগন্তকে বলেন, কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট অপরাধ সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের আইন দরকার। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে সেই আইনে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া সংক্রান্ত ধারা থাকতে পারে না। তা হলে সেই আইনের অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার হতে বাধ্য। তিনি বলেন, কম্পিউটার সংক্রান্ত সাইবার অপরাধের জন্য এই আইন। কিন্তু ভাবমূর্তি হানি করা বা ক্ষুণ্ণ করা বা অপমান করার জন্য কোথাও আইন নেই। দুনিয়ার কোনো গণতান্ত্রিক দেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার কারণে অপরাধের এমন আইন নাই। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৯ ও ৩০ এই পাঁচটি ধারা অবিলম্বে বিলোপ করতে হবে।
ড. শাহদীন মালিক আরো বলেন, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করাটা ক্রিমিনাল ল’ তে নেই। ১৮৫০ সালের আগে এই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার বিষয় ছিল। এর একমাত্র উদ্দেশ্য মতপ্রকাশ বা বাকস্বাধীনতা ক্ষুণœ করা। ইজ্জত যাওয়ার ধারাগুলো আইনে থাকতে পারে না।
তিনি বলেন, কম্পিউটার হ্যাকিং, কম্পিউটারের ডিভাইস হ্যাক করা, ডাটা চুরি সংক্রন্ত যেসব অপরাধ ওইগুলো আইনে ছিল না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এ জন্য দরকার।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদ মৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদের মুখে এ আইনের কিছু পরিবর্তন আনার কথা উল্লেখ করে সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এই আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে তদন্তের আগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়া যাবে না- এমন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা বলেছি যে, সরাসরি মামলা নেয়া হবে না। কোনো অভিযোগ এলে পুলিশ প্রথমে তদন্ত করে দেখবে এবং তদন্ত সাপেক্ষে তার পরে মামলা নেয়া হবে। মন্ত্রী আরো বলেন, আগে যাতে আটক না করে এবং তদন্তের জন্য যেন অপেক্ষা করে- সেই জায়গায় আসার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।
এই আইনে মামলা হলে জামিন হওয়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, সাজা যতটা হলে জামিন হবে এবং যতটা হলে জামিন হবে না- ঠিক সেই প্রিন্সিপালটা ফলো করে আমরা বিধান করেছি। সারা পৃথিবীতেই এটা করা হয়। এমনকি এই উপমহাদেশেও। বিষয়টা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করছি।
সরকার নানা বিতর্কের মধ্যেই ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে। শুরুতে সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীরা এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়েও তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। আইনমন্ত্রী তখন সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছিলেন এই আইনে সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হবেন না। তবে এই আইনে ৯ মাস ধরে আটক থাকা লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর অভিযোগ উঠেছে যে, ছয়বার আবেদন করেও তার জামিন মেলেনি।