আটক কার্টুনিস্ট কিশোরকে র্যাব কার্যালয়ে নেয়া হলে সেখানেই দেখা হয়েছিল মুশতাক আহমেদের সঙ্গে। একইসঙ্গে দশ মাস বন্দি ছিলেন দুজন। পরিকল্পনা করেছিলেন জামিন পেলে দুজনই যাবেন হিমালয়ের বেসক্যাম্পে। ঘুরে বেড়াবেন। তা আর হয়ে উঠেনি। দফায় দফায় জামিন বাতিল হলে অবশেষে দশ মাস পর কিশোরের জামিন মিললেও অপর লেখক ও ব্লগার মুশতাক আহমেদ চলে গেলেন চিরজামিনে। হিমালয়ে যাওয়া হলো না তাদের দুজনের।
গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে কিশোর আরও বলেন, র্যাব কার্যালয়ে সেদিন মুশতাক আহমেদ আমাকে বলেছিলেন, ‘মুখ গোমড়া করে রেখেছিস কেন? আমরা কি কোনো অন্যায় করেছি? বুক চিতিয়ে দাঁড়া।’
জামিনে মুক্ত কিশোর গ্রেপ্তারের পর অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।
গতকাল আইনজীবীর কার্যালয়ে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এ সময় শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের ক্ষত চিহ্নও দেখান। বলেন, গত বছরের ২রা মে কিশোরকে রাজধানীর কাকরাইলের বাসা থেকে কিশোরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখায় র্যাব-৩। তুলে নেয়ার পর থেকে গ্রেপ্তার দেখানোর আগ পর্যন্ত ৬৯ ঘণ্টা কোথায় ছিলেন তা জানেন না তিনি। ওই সময় কয়েক দফা তার ওপর চলে নির্যাতন। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান কার্টুনিস্ট কিশোর। সেখান থেকে ঢাকায় ফিরে হাসপাতালে ভর্তির আগে আইনজীবীর চেম্বারে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। গাড়ি থেকে নেমে আইনজীবীর চেম্বারে প্রবেশের সময় তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখা যায়। এসময় শরীরে ক্ষত স্থানে চিহ্ন দেখিয়ে কিশোর বলেন, কান দিয়ে পুঁজ পড়ছে। দুই পায়ে কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। কারাগারের ১০ মাসে সুচিকিৎসা পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সেদিনের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে কিশোর বলেন, ২রা মে রাতে ১৬-১৭ জন আইনশৃঙ্খলা পরিচয়ে বাসায় ঢুকে। একজন বলেছিলেন, তাঁর নাম জসিম। অন্তত চারজনের কাছে ছোট অস্ত্র ছিল, কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল না। ঘরে ঢুকেই তল্লাশি শুরু করেন। পুরো বাসা একরকম লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে কিশোরের মুঠোফোন, সিপিইউ, পোর্টেবল হার্ডডিস্কসহ যত ডিজিটাল ডিভাইস ছিল, সব নিয়ে কিশোরকে হাতকড়া পরান। তারপর নিচে নামান। বাসার সামনে তখন ৬-৭টি গাড়ি। কিশোর চেঁচামেচি শুরু করেন এ সময়। কাকরাইলে বাসার সামনে লোক জমে গেলে নাক পর্যন্ত ঢাকা বিশেষ ধরনের টুপি পরিয়ে কিশোরকে গাড়িতে তোলেন তাঁরা। উচ্চ শব্দে গান ছেড়ে দিলে কিশোরের চিৎকার মিলিয়ে যায়। এরপর তাকে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে।
প্রথমে একটি স্যাঁতসেঁতে ঘরে নিয়ে যায়। অনেক রাতে তুলে তাঁকে নেওয়া হয় অন্য একটি কক্ষে। ওই ঘরেও ছিলেন বেশ কয়েকজন। তাঁদের সবাই কার্টুনিস্ট কিশোরকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করছিলেন। চেয়ারে বসিয়ে কেউ একজন ইংরেজিতে বলেন, পেছনে তাকালে জানে মেরে ফেলবেন। এরপর প্রজেক্টরে একটার পর একটা কার্টুন দেখিয়ে মর্মার্থ জানতে চাওয়া হয়।
বেশ কিছু কার্টুন দেখিয়ে, এগুলো কেন আঁকা হয়েছে, কার্টুনের চরিত্রগুলো কারা, তা জানতে চায়। একপর্যায়ে প্রচণ্ড জোরে কানে থাপ্পড় দেয়। কিছুক্ষণের জন্য বোধশক্তিহীন হয়ে পড়ি। বুঝতে পারি, কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এরপর স্টিলের পাত বসানো লাঠি দিয়ে পায়ে পেটাতে থাকে তারা।’
নির্যাতনের এক পর্যায়ে তারা জানতে চান, কার কার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, কেন যোগাযোগ। সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক তাসনীম খলিলের সঙ্গে তাঁর কীভাবে যোগাযোগ, ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে কী করে চেনেন- এসব প্রশ্ন করেন। ব্লগারদের ওপর আবার হামলা হতে পারে, এই আশঙ্কার কথা কেন আসিফ মহিউদ্দীনকে বলেছেন, জানতে চান তাঁরা। জবাবে কিশোর বলেছিলেন, তাঁর মনে হচ্ছিল, কেউ তাঁকে অনুসরণ করে। তবে তাঁর কোনো জবাবই মনঃপুত হচ্ছিল না প্রশ্নকর্তাদের। কিশোর বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের একটা অংশজুড়ে বেসরকারি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। তিনি ওই ব্যবসায়ীকে কীভাবে চেনেন, কেন ওই ব্যক্তির কার্টুন এঁকেছেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদের পর কিশোরকে র্যাবের কার্যালয়ে রেখে আসা হয়।
ওখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় লেখক মুশতাক আহমেদের। বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল বলে মুশতাক জানিয়েছিলেন কিশোরকে। পরে ৬ মে সকালে রমনা থানায় সোপর্দ করা হয় কিশোর ও মুশতাককে। তবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনে যেকোনো বক্তব্য দিতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কার্টুনিস্ট কিশোরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। গত বছরের মে মাসে গ্রেপ্তারের পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। এত পরে এমন অভিযোগ উঠলে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ থাকে।
কিশোর জানান, তাঁদের প্রথমে কেরানীগঞ্জে কারাগারে রাখা হয়। পরে কাশিমপুর কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর মুশতাককে হাই সিকিউরিটি ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। দুজনের শেষ দেখা হয় গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির করার পর।