টিকা নেয়ার পর কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত টিকা দেয়া হয়েছে সাড়ে ২৮ লাখের বেশি মানুষকে। এর মধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দুইজন কর্মকর্তা ও একজন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নেয়ার পাশাপাশি আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা একটি অন্যতম পন্থা। একমাত্র পন্থা নয়। টিকা নিলেও তাদের আগের মতোই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
টিকা নেয়ার ১২ দিন পর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন। বর্তমানে তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স. ম. গোলাম কিবরিয়াও টিকা নেয়ার ৬ষ্ঠ দিনের মাথায় আক্রান্ত হন। তিনি তার ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, ‘টিকা নিয়েছি ১০ই ফেব্রুয়ারি। টিকা নেয়ার ৬ষ্ঠ দিনে আক্রান্ত হলাম।’ সচিবালয় ক্লিনিকে টিকা নেন তিনি। ২১শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সস্ত্রীক ভর্তি হন। তার স্ত্রীসহ পরিবারের আরো দুই সদস্যও করোনা পজেটিভ বলে জানান তিনি।
টিকা নেয়ার পর রাজধানীর সাজ্জাদ হোসেন নামের এক স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার হিসেবে কর্মরত। গত ৭ই ফেব্রুয়ারি দেশে গণটিকাদান শুরুর পরদিন তিনি টিকা নেন। এর ১৬ দিনের মাথায় মঙ্গলবার তার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। সাজ্জাদ বলেন, টিকা নেয়ার স্থানে প্রথমে ব্যথা এবং পরে জ্বর অনুভব করেন। টানা দু’দিন জ্বর ছিল। তবে প্যারাসিটামল ওষুধ সেবনে তা সেরে যায়। পরে হাসপাতালে কাজে ফেরেন। আবারো জ্বরজ্বর অনুভব করেন। তাই গত সোমবার তিনি করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। মঙ্গলবার ওই নমুনা পরীক্ষার ফল পজেটিভ আসে। বর্তমানে তিনি বাসায় আইসোলেশনে আছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা এ ব্যাপারে বলেন, টিকা নেয়ার পরও সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা সবার ক্ষেত্রে পুরোপুরি দূর হয় না। টিকা দিলে ট্রান্সমিশন কমে যাবে। কমানোর জন্যই টিকা দেয়া। তবে সংক্রমণ হতে পারে। কারণ টিকা শতভাগ কার্যকর হবে- এমন কথা তো কোনো টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানই বলেনি।
টিকা নেয়ার পর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ভাইরাসটির শক্তিকালীন সময় ১৫ দিন। এর আগেই তিনি সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন। তিনি হয়তো টের পাননি। তার লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। কিন্তু তিনি সংক্রমিত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ এ ব্যাপারে বলেন, বিষয়টি এরকম যে, আমরা টিকা দিলে করোনার প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। টিকার একটি কার্যকর সময় আছে। ৭ দিন পর অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু হয়। তার মানে এমন নয় যে, করোনা হবে না। ধীরে ধীরে অ্যান্টিবডি বৃদ্ধি পাবে। সুরক্ষা দেবে। তিনি বলেন, করোনার টিকার প্রথম ডোজ দেয়ার ৮ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ। তখন দেখা যাবে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে তার এ সংক্রমণটা হবে না। তিনি তো এখনো দ্বিতীয় ডোজ নেননি। তার সুরক্ষা হয়নি। এই জনস্বাস্থ্যবিদ আরো বলেন, ভাইরাসটির একটি শক্তিকালীন সময় থাকে ১৪ দিন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, টিকা নেয়ার পাশাপাশি মাস্ক পরা, ঘনঘন সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া, জনসমাবেশ এড়িয়ে চলার মতো স্বাস্থ্যবিধিগুলো আমাদের মানতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে টিকা মৃত্যু কমাবে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা একটি অন্যতম পন্থা। একমাত্র পন্থা নয়।
টিকা নিয়েও দেশে দেশে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড বিশ্বের অনেক দেশে রয়েছে। গত বছরের ১৮ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগোর নার্স ম্যাথিউ ডব্লিউ ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ নেন। এরপর ৮ দিনের মাথায় তিনি করোনা পজেটিভ হন। টিকা নেয়ার পর মানবদেহ করোনার জেনেটিক উপাদানগুলো শনাক্ত করতে এবং অ্যান্টিবডি ও টি-সেল তৈরি করতে বেশ খানিকটা সময় নেয় বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এরপর ধীরে ধীরে এগুলো ভাইরাসের দেহকোষে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বা আক্রান্ত কোষগুলোকে মেরে ফেলতে সক্রিয় হয়ে ওঠে।