ঢাকা: শতবছরে পা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাই এখন দেশের খ্যাতনামা এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশদ আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে হবে- তাই এই আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য একজনকে প্রাচীন রোমান পুরাণে থাকা দেবতা জানুসের মতো হতে হবে। দেবতা জানুসের ছিল সামনে-পেছনে দু’টি মুখমণ্ডল। তার চোখ ছিল ৪টি। এ কারণে জানুস চাইলেই সামনে এবং পেছনে দু’দিকেই দেখতে পারতেন। জানুসের মতো চিন্তা করতেন এমন আরেকজন মানুষ ছিলেন উইনস্টন চার্চিল (১৮৭৪-১৯৬৫)।
তিনি লিখেছিলেন, দীর্ঘ অতীতে দেখতে পারলে ভবিষ্যতের দেখা পাওয়া যায়। ঘটনাচক্রে আগস্টে কমতেও (১৭৯৮-১৮৫৭) চার্চিলের মতোই ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যেসব মতবাদ অতীতকে পরিচালনা করেছে তা ভবিষ্যতকেও অবিচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা করবে।
গত এক শতকে ভালো-মন্দ মিলিয়েই এগিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ভালো কাজের সঙ্গে মিশে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবোধ ও চেতনাবিরোধী কাজও। তাই, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত যা বাদ পড়েছে তা নিয়ে পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জন হেনরি নিউম্যান ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে ধারণা তার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্যগত মিল অসংখ্য প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তন ও বর্তমানে এর অবস্থা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা হচ্ছেন স্যার খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর (১৮৭১-১৯১৫)। ১৯১১ সালের আগস্ট মাসে কার্জন হলের একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম পূর্ব বাংলার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব তোলেন। বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়ার আগেই এই দাবি উপস্থাপিত হয়েছিল। দুই বাংলা এক হওয়ার পর এ নিয়ে অসন্তুষ্ট সলিমুল্লাহ বাহাদুর বৃটিশ লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে কিছু দাবি উপস্থাপন করেন। বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়ায় যে মুসলিমদের স্বার্থ বিনষ্ট হয়েছে তাদেরকে পুরস্কৃত করতে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলেন তিনি। বঙ্গভঙ্গ বাতিল না হলে বৃটিশরা এমন দাবি মানতো কিনা তা নিয়ে তর্ক রয়েছে। তাই বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়া প্রথমে মুসলিমদের জন্য নেতিবাচক মনে হলেও দ্রুতই তা আশীর্বাদে পরিণত হয়।
তবে স্থানীয়ভাবে অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন। তবে সলিমুল্লাহ বাহাদুর সেসব সামাল দেন। ১৯১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া যায়। এছাড়া, স্যাডলার কমিশনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর পক্ষে মত দিলো যাতে করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমানো যায়। ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস হয়। এতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে বৃটিশ মডেলে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। তবে ১৯৭৩ সালে আবারো বিশ্ববিদ্যালয়টিকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। এরপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই স্বাধীনতা নিয়েই পরিচালিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ছিলেন ড. ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। ১৯২১ সালের ১লা জুলাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কর্মকাণ্ড চালু করেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল মানবিক, বিজ্ঞান ও আইনের তিনটি ফ্যাকাল্টিসহ মোট ১২টি ডিপার্টমেন্ট। শিক্ষার্থীদের থাকার জন্যে ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা হল এবং জগন্নাথ হল। প্রাথমিকভাবে সলিমুল্লাহ খানের দেয়া ৬০০ একর জমির ওপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই জমির অনেকাংশই দখলদাররা দখল করে নিয়েছে। এর সুস্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, জামায়াত-ই-ইসলামী পরিচালিত কাঁটাবন মসজিদ। অথচ ইসলাম বলে, দখলকৃত জমির ওপরে মসজিদ নির্মাণ করা যায় না। বর্তমানে ঢাবিতে রয়েছে ১৩টি ফ্যাকাল্টি, ৮৩টি ডিপার্টমেন্ট, ১২টি প্রতিষ্ঠান, ১৯৯২ ফ্যাকাল্টি সদস্য, ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী, ২০টি হল, ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র, ৩টি হোস্টেল। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন মোট ২৮ জন। অর্থাৎ গত একশ’ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধি অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু একইসময়ে কতখানি গঠনমূলক কাজের বিস্তার হয়েছে তা লেখার পরবর্তী অংশে আলোচনা করা হবে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন তা বিচার করা হয় বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে। এই র্যাঙ্কিং করে থাকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। ২০১৮ সালের ‘দ্যা টাইমস হাইয়ার এডুকেশন্থ র্যাংকে ঢাবি’র অবস্থান ছিল ১০০১তম। ২০২১ সালের কিউএস এশিয়া র্যাঙ্কিংয়ে এশিয়ার ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পেয়েছে ১১ বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে রয়েছে ঢাবি, বুয়েট ও কুয়েট। বাকিগুলো সব বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের হিসেবে ঢাবি এগিয়ে থাকলেও বৈশ্বিক হিসাব বলছে অন্য কথা। পরিমাণ এবং মান একই বিষয় নয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো তার এমন বাজে র্যাঙ্কিং মানা যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বাধীনতা এবং এর উদ্দেশ্য
বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বাধীনতা ও এর উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। লাতিন শব্দ universitas এর অর্থ হচ্ছে সামগ্রিকতা। একে বলা হয়, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের সমপ্রদায়ই বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এতে থাকে শিক্ষার্থীরাও। তবে এখানে থাকা সবারই একটাই সাধারণ উদ্দেশ্য তা হলো, জ্ঞান অন্বেষণ। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বলতে যা বোঝায় সেটি হচ্ছে, কোনো বিষয়ে সামগ্রিক তথ্যের সমন্বয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশ্ব সমপর্কে জানার একটি প্রতিষ্ঠান।
২০১৮ সালের ১৭ই এপ্রিল লন্ডনের পিয়ারসন কলেজ আয়োজিত একটি আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য সমপর্কে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অন্বেষণের নেতৃত্ব দেবে, জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করবে, জ্ঞানের সাধনা করবে এবং জ্ঞানের প্রচার করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গেই মিশে আছে এর একাডেমিক স্বাধীনতার বিষয়টি। ১১৫৫ সালে বোলোগানা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম তাদের একাডেমিক সনদে Constitutio Habita যুক্ত করে। এরমধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের একাডেমিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। ১৯৮৮ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর বিশ্বের ৪৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টররা ম্যাগনা কার্টা ইউনিভার্সিটাটামে (Magna Charta Universitatum) স্বাক্ষর করেন। এদিন ছিল বোলোগানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
ঢাবির প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর স্যার পি. জে. হার্টগই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বাধীনতার বিষয়টির যাত্রা শুরু করেন। তিনি ঢাবিকে গড়তে চেয়েছিলেন জ্ঞানের উৎস ও প্রচারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে। আমরা যদি জানুসের পেছনের চোখ দিয়ে ঢাবির গত একশ’ বছরের দিকে তাকাই তাহলে প্রশ্ন জাগবে, হার্টগের এই উদ্দেশ্য কতখানি বাস্তবায়িত হয়েছে? এর উত্তর হবে মিশ্র। ঢাবিতে এমন দিন ছিল যখন এটি শিক্ষা ও গবেষণায় অসাধারণ ছিল। মানসম্মত পড়াশোনা ও কর্তৃপক্ষের চেষ্টায় এই সফলতা অর্জন করা গেছে। কর্তৃপক্ষ মানসম্মত হলে তাদের নিয়োগও মানসম্মত হবে। আর মানসম্মত কর্তৃপক্ষ নির্ভর করে সরকারের ওপরে। ঢাবির পিছলে যাওয়ার শুরু হয় পাকিস্তান শাসনামলে। বর্তমানের ঢাবিতে দেখা যায় অন্যচিত্র। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান শাসনামলে জারি করা হয় এক কালো আইন। এরমধ্য দিয়ে ঢাবিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয় যার কোনো একাডেমিক স্বাধীনতা ছিল না। এরপর ১৯৭৩ সালে ঢাবির একাডেমিক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে এই নির্দেশনায় ঢাবি কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রধান দুই উপাদান এখানে অনুপস্থিত ছিল। অপরদিকে স্বায়ত্তশাসনের আড়ালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নানা অপকর্ম ঢাকা পড়তে শুরু করে। ছিল সরকারের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণও। ১৯৯০ এর দশক থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচনও দেখা যায়নি ঢাবিতে। শিক্ষকদের মধ্যেও দেখা যায় রাজনীতিকরণ। নীল রঙ ধারণ করে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা আর সাদা রঙ ধারণ করে বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা। এরমধ্যে গোলাপি রঙ কথিত প্রগতিশীল শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ
গত একশ’ বছরের ব্যালেন্স শিটে ঢাবি অসংখ্য জ্ঞানীর জন্ম দিয়েছে। যদিও বর্তমানে এখান থেকে দায়িত্ববান ব্যক্তি বের হতেই বেশি দেখা যায়। অতীতে এক সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বজুড়ে নামকরা অনেক ব্যক্তি পড়াতেন। তারা জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধিতে অনেক অবদান রেখেছিলেন। এরমধ্যে রয়েছেন- সত্যেন্দ্রনাথ বোস, জে সি ঘোষ, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুকার্মা হুসাইন খন্দকার, কাজী মোতাহার হোসেন, কে জে নিউম্যান, আহমেদ হাসান ডানি, কালিকারঞ্জন কানুঙ্গো এবং আর সি মজুমদার। আইনস্টাইনের সঙ্গে মিলে বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বোস। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলা ভাষার আদিলিপি চর্যাপদের সন্ধানদাতা।
১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঢাবি ছিল বাঙালির প্রগতিশীল আন্দোলনের জন্মস্থান। এই আন্দোলনগুলো শুধু তরুণদের হাতেই গড়ে উঠেছিল। এগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে ব্যাপক অবদান রেখেছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের কারণে ১৯৫৬ সালে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন আইয়ুব খানের বৈষম্যমূলক এবং সামপ্রদায়িক শিক্ষানীতি বাতিল করেছিল। ৬ দফা আন্দোলনের দাবিতে আয়োজিত জনসভাগুলোও ঢাবির শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বেই আয়োজিত হয়েছে। ৬ দফার সঙ্গে মিলে ১৯৬৯ সালে শিক্ষার্থীরা নিয়ে আসলো ১১ দফা দাবি। এ বছরই ২৪শে জানুয়ারি থেকে ২২শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে বড় বড় জনসমাবেশ করে তারা স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করেছিল। সে সময়কারই একটি স্লোগান ছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটিও এ সময় মানুষের কাছে আসে প্রথম। ছাত্রদের আন্দোলনেই আইয়ুব খানের পতন হয় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান। ২৩শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করা হয় এবং ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান করেন। ১৯৭০ সালের ৬-৭ই জুন শিক্ষার্থীরা ইকবাল হলে ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করা হয়। ঢাবির আর্টস ফ্যাকাল্টি ভবনে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ এই পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত চলা অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল শিক্ষার্থীরাই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই তরুণরাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের সেই গৌরবদীপ্ত সময় হারিয়ে যেতে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধে যাওয়া শিক্ষার্থীরা প্রথম অটো-প্রমোশনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর মুজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী তখন বলেছিলেন, আমার লাশের ওপর দিয়ে গিয়ে অটো প্রমোশন নিতে হবে। পরিস্থিতি সামলাতে বঙ্গবন্ধুকে ক্যামপাসে আসতে হয়েছিল। ১৯৮০’র দশকে আবারো ঢাবি শিক্ষার্থীদের গৌরবদীপ্ত সময় ফিরে আসে। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনে স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে ঢাবি শিক্ষার্থীরা। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে পতন হয় এরশাদের। এরপর থেকে ঢাবির আর কোনো বড় অর্জন দেখা যায়নি।
হানাদারদের পরিচালিত অপারেশন সার্চ লাইটের আসল উদ্দেশ্য ছিল ঢাবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হত্যা করা। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড হয়েছে তারও উদ্দেশ্য ছিল একই। এতে যে শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে রয়েছেন, জি সি দেব, এএনএম মুনিরুজ্জামান, সান্তোস চন্দ্র ভট্টাচার্য্য, জোতির্ময় গুহ, এএন মুনির চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আব্দুল খায়ের, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, সেরাজুল হক খান, রাশিদুল হাসান, আনোয়ার পাশা, ফজলুর রহমান, ফাইজুল মোহি, আব্দুল মুক্তাদির, সারাফান আলী, সাদাত আলী, এআর খান এবং অনুদাইপায়ান ভট্টাচার্য্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। তবে বাস্তবে এটি প্রথম হিসেবে পারফর্ম করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষা এবং গবেষণা, উভয় ক্ষেত্রেই এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের আশা অনেক বেশি। উচ্চশিক্ষা মানে হচ্ছে শিক্ষা এবং গবেষণা। হার্টগ নিজেও বলেছিলেন, গবেষণা ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম ব্যর্থ হবে। নিচের টেবিলে ঢাবির গবেষণা সমপর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে।
অর্থবছর গবেষণার জন্য বরাদ্দ গবেষণার সংখ্যা
২০১৬-১৭ ৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা ৫৫
২০১৭-১৮ ৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ৫৫
২০১৮-১৯ ৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ৫৫
২০১৯-২০ ৮ কোটি তথ্য নেই
২০১৯-২০ অর্থবছরের গবেষণাগুলোর মান নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অর্থায়ন ছাড়াই ঢাবি শিক্ষকরা অসাধারণ সব গবেষণা করেছেন। তাছাড়া, অর্থায়নের ওপর গবেষণার মান ও সংখ্যা নির্ভর করে না। এটি পুরোপুরি নির্ভর করে গবেষকের ইচ্ছা ও সক্ষমতার ওপরে। সমপ্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষণার মান জানতে তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এতে জানা যায়, গবেষণার ৯৮ শতাংশই প্লেগারিজম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি। সমাপ্তি
বর্তমান হচ্ছে মূলত অতীতের চলমান অংশ। তবে মানবজীবন কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ও বর্তমানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বর্তমানের সঙ্গে অতীতের ঢাবির মিল নেই। অতীতে এই প্রতিষ্ঠানের ছিল আলোকজ্জল ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেদিন গত হয়েছে। অতীতে এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত ছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে কিন্তু বর্তমানে এটি সেই স্থান থেকে পিছলে গেছে। শতবার্ষিকীতে তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এই অধঃপতনের কারণ খুঁজে বের করতে হবে। সবমিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির আবারো নতুন করে যাত্রা করা উচিত।
লেখক: চেয়ার প্রফেসর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)