নির্বাচনে সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্রমবর্ধমান ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন। নির্বাচনকালে আপনাদের হাতে যে অপরিমেয় ক্ষমতা আছে, তা প্রয়োগ করে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কেন নিশ্চিত করা যাবে না তা আমার বোধগম্য নয়। পাশাপাশি এ কথাও বলে দিতে চাই, নির্বাচনের দায়িত্বপালনে কারও কোনো শিথিলতা বরদাস্ত করা হবে না। এ বিষয়ে আমরা ‘শূন্য সহিষ্ণু নীতি’ বা জিরো টলারেন্সে’ বিশ্বাসী। ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের আসন্ন ২৯টি পৌরসভার নির্বাচন উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের সাথে ‘জুম মিটিং’এ জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে অনুষ্ঠেয় পৌরসভা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সভাপতিত্বে বুধবার ‘জুম মিটিং’অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনা-২ অধিশাখার যুগ্মসচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান এই সভা সঞ্চালনা করেন। ‘জুম মিটিং’এ উল্লিখিত পৌরসভাসমূহের রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকগণ তাদের প্রস্ততি ও সমস্যাসমূহ উপস্থাপন করেন। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যাগুলোর সম্ভাব্য সমাধানকল্পে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন।
সভায় শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারগণ উপস্থিত ছিলেন। উল্লিখিত ‘জুম মিটিং’ এ সকল পৌরসভার রিটার্নিং অফিসারগণ ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাগণ এবং পৌরসভাগুলির নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
যে সকল পৌরসভাগুলোতে ৪র্থ ধাপে অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে, তা হচ্ছে শ্রীবরদী, শেরপুর, মেলান্দহ, নেত্রকোণা সদর, ফুলপুর, ত্রিশাল, মুন্সীগঞ্জ সদর, নরসিংদী সদর, রাজবাড়ী, কালিহাতি, গোপালপুর, ডামুড্যা, কালকিনি, নগরকান্দা, বাজিতপুর, করিমগঞ্জ ও হোসেনপুর। ৫ম ধাপে অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে যে সকল পৌরসভায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে, তা হচ্ছে- দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, জামালপুর, নান্দাইল, ভৈরব, সিংগাইর, শিবচর, মাদারীপুর ও কালীগঞ্জ।
৪র্থ ধাপে মোট ২৬টি পৌরসভায় ব্যালট পেপারের মাধ্যমে এবং ৩০টি পৌরসভায় ইভিএম এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। পঞ্চম ধাপে ৩১টি পৌরসভায় ইভিএম এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
মাহবুব তালুকদার মতবিনিময় সভায় তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, সংবিধানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আমার বক্তব্য আরম্ভ করতে চাই। এর রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অংশে বলা হয়েছে, প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে। এর অর্থ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশগ্রহণ করে। তিনি বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নির্যাস হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের পূর্ব শর্তই হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার প্রতিটি আইনকানুন ও আচরণবিধি কঠোরভাবে পালনের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন করে আমরা গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত করতে চাই।
ইসি মাহবুব বলেন, এবার ভোটের কথা। ভোট দুই অক্ষরের ছোট শব্দ হলেও এর ব্যাপ্তি অত্যন্ত বিস্তৃত বিশাল ও ব্যাপক। ভোট জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতীক ও জনগণের রক্ষাকবচ। সম্প্রতি ভোটারদের ভোটবিমুখতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটি গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। এর কারণগুলো বিশ্লেষণ করে তা প্রতিকারের প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্বপালনের জন্য আমরা শপথ গ্রহণ করেছি। আপনারা আমাদের শপথের অংশীদার। কারণ নির্বাচন আমরা সরাসরি করিনা, নির্বাচন করেন আপনারা। নির্বাচন কমিশনের সকল ক্ষমতা ও শক্তি এখন আপনাদের কাছে হস্তান্তরিত। কমিশনের নির্দেশে আপনারা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। তিনি বলেন, একটি কথা স্পষ্টভাবে বলতে চাই। নির্বাচনি দায়িত্ব যারা পালন করবেন, তাদের কাছ থেকে পক্ষপাতমূলক আচরণ কখনও আশা করি না। আমরা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে দায়িত্ব পালন করতে আসিনি। সকল প্রার্থী আমাদের কাছে এক এবং অভিন্ন। সকলের প্রতি আচরণে আপনাদের ভূমিকা হচ্ছে বিচারকের মতো নির্মোহ।
জ্যেষ্ঠ কমিশনার বলেন, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনি ব্যবস্থাপনাকে আমি ৫টি ‘নি’ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছি। প্রথম ‘নি’ হচ্ছে ‘নিশ্চয়তা’, এটা নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা। এ নিশ্চয়তার অর্থ ভোটার ও রাজনৈতিক দলে আস্থা সৃষ্টি। দ্বিতীয় ‘নি’ হচ্ছে ‘নিরপেক্ষতা’: নির্বিঘ্নে ভোট প্রদান ও ভোট কার্যক্রম চালানোর প্রতিশ্রুতি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এই নিরপেক্ষতা অপরিহার্য।
তিনি বলেন, তৃতীয় ‘নি’ হচ্ছে ‘নিরাপত্তা’: এই নিরাপত্তা ভোটার, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রæতি। এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকরভাবে নির্বাচনকালে কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত¦বাবধানে নিয়ে আসা দরকার। চতুর্থ ‘নি’ হচ্ছে ‘নিয়ম-নীতি’: নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোরভাবে বিধি-বিধান পরিপালনের আওতায় আনা প্রয়োজন। পঞ্চম ‘নি’ হচ্ছে ‘নিয়ন্ত্রণ’: নির্বাচন অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। স্বনিয়ন্ত্রণই নির্বাচন কমিশনের মূল কথা।
তিনি বলেন, নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় নিশ্চয়তা, নিরপেক্ষতা, নিরাপত্তা, নিয়ম-নীতি ও নিয়ন্ত্রণ কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। তবে এই সংজ্ঞা নির্ধারণ নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত উদঘাটন। এর সাথে নির্বাচন কমিশনের কোনো সম্পর্ক নেই।