দেশজুড়ে শুরু হয়েছে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎসব। সারা দেশে একযোগে শুরু হয়েছে করোনা টিকাদান কর্মসূচি। প্রথমদিন টিকা নিয়েছেন ৩১ হাজার ১৬০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৩ হাজার ৮৫৭ এবং নারী ৭ হাজার ৩০৩ জন। ঢাকা মহানগরে টিকা নিয়েছেন ৫ হাজার ৭১ জন। টিকা নেয়ার পর সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে ২১ জনের। এই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য বলে স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। নিবন্ধন করার পরও প্রথমদিন অনেকে টিকা নিতে আসেননি।
তবে দিন শেষে ৩০ হাজারের ঘর ছাড়ানোয় স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টরা খুশি। তারা বলছেন, এখন ব্যাপকহারে মানুষ টিকা নিতে আসবেন। রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে টিকা নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, এমপি, সরকারের সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে টিকা নিয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষও। টিকা দেয়াকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কেন্দ্রে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। টিকা নেয়ার আগে ভয় কাজ করলেও টিকা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন অনেকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ঢাকা মহানগর ব্যতীত ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতে নিয়েছেন ৪ হাজার ৪৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১ হাজার ৬৯৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৬ হাজার ৪৪৩ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩ হাজার ৭৫৭ জন, রংপুর বিভাগে ২ হাজার ৯১২ জন, খুলনা বিভাগে ৩ হাজার ২৩৩ জন, বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৪১২ জন এবং সিলেট বিভাগে টিকা নিয়েছেন ২ হাজার ৩৯৬ জন। ২১ জনের সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন জ্বর, টিকা নেয়ার স্থানে লাল হওয়া ইত্যাদি খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৫০ জনকে টিকা দেয়ার কথা ছিল প্রথমদিন। কিন্তু পৌনে ৩টা পর্যন্ত ৪৬ জন টিকা নিয়েছেন। এই কেন্দ্রে টিকা নিতে আসেন ৬২ বছর বয়সী আকবর নিয়াজ আজাদ। তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। টিকা নেয়ার পর বলেন, ভালো আছি। শনিবার দিবাগত রাত ১টা ২৪ মিনিটে টিকা নেয়ার মেসেজ পান। নিবন্ধন করেছিলেন শনিবার সকাল ১১টায়। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নির্ধারিত ১৬২ জনের মধ্যে টিকা নিয়েছেন ১৬০ জন। এদিকে, বিকাল ৫টা পর্যন্ত টিকা নিতে নিবন্ধন করেছেন ৪ লাখ ৯ হাজারের কিছু বেশি।
গত ২৭শে জানুয়ারি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টিকাদানের উদ্বোধন করা হয়। এরপর গতকাল শুরু হয়েছে দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি। দিনের শুরুতেই রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এখানে আরো ৫ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী টিকা নিয়েছেন। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন সরকার ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। সারা দেশের মোট ১ হাজার ৫টি হাসপাতালে এই টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। করোনাভাইরাসের টিকা নেয়ার পর ভালো আছেন ৬ মন্ত্রী। সবাই সুস্থ আছেন, করোরই কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি বলে জানিয়েছেন তারা।
গতকাল বেলা ১১টা ২০মিনিটে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে করোনার টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধনের শুরুতেই টিকা নেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক। এরপর ওই কেন্দ্রেই একে একে টিকা নেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, মৎস্য ও পশু সম্পদমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। এছাড়া কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী, স্বাচিপ (স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান, মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা টিকা নেয়ার পর অন্যরা পর্যায়ক্রমে টিকা নেন এ কেন্দ্রে। তবে প্রথম ধাপে ১৮ ক্যাটাগরির মানুষ টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন।
রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ৫০টি এবং বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্য়ায়ে ৯৫৫টিসহ সর্বমোট ১ হাজার ৫টি সরকারি হাসপাতাল, মাতৃসদন ও ক্লিনিকে টিকা প্রদান করা হচ্ছে। টিকাদান করতে রাজধানী ঢাকায় ২০৪টি দলসহ সারা দেশে ২ হাজার ৪০০ দল কাজ করছে। প্রতি দলে দু’জন স্বাস্থ্যকর্মী ও ৪ জন স্বেচ্ছাসেবীসহ ৬ জন সদস্য রয়েছেন। প্রতি দলের টার্গেট দৈনিক ১৫০ জনকে টিকা দেয়া। সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত টিকা দেয়া হবে।
টিকা নেরয়ার পর ৬ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী যা বললেন: করোনাভাইরাসের টিকা নেয়ার পর ভালো আছেন ৬ মন্ত্রী। সবাই সুস্থ আছেন, করোরই কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি বলে জানিয়েছেন তারা। গতকাল সকাল ১০টায় সারা দেশে টিকা প্রদান কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে টিকা নেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক। এরপর ওই কেন্দ্রেই তারা টিকা গ্রহণ করেন। পরে তাদের ওই হাসপাতালের বিশ্রামাগারে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। টিকা নেয়ার ঘণ্টাখানেক পর এক প্রতিক্রিয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা মন্ত্রীরা যারা টিকা নিয়েছি তারা সবাই ভালো আছি। সবাই সুস্থ বোধ করছি। যে হাতে আমি টিকা নিয়েছি সে হাতে ব্যথা অনুভূত হয়নি।
তিনি আরো বলেন, দেশব্যাপী যে এক হাজারেরও বেশি কেন্দ্রে টিকা দেয়া হচ্ছে কোথাও থেকে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার খবর আসেনি। করোনা প্রতিরোধী টিকা গ্রহণের পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আমরা এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম, আজ আমাদের আনন্দের দিন। আর টিকা নিয়ে যেন কোনো গুজব না হয়। তিনি বলেন, টিকা নিয়ে আমরা ভালো আছি, কারো কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, ৭০ লাখ টিকা এখন হাতে আছে, আগামীতে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে ৬ কোটি টিকা পাওয়া যাবে। এর জন্য বিরাট কর্মযজ্ঞ দরকার। এই টিকা দিতে আইসিটি মন্ত্রণালয় অ্যাপ তৈরি করেছে, জেলায় জেলায় ৭ হাজারের বেশি টিম কাজ করছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, টিকা নেয়ার পর আমি খুব আনন্দিত, স্বস্তি বোধ করছি। কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয়নি। গুজবে কান না দিয়ে সবাইকে টিকা নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
টিকা নেয়ার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এমপি করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে বিভিন্ন মহলের নেতিবাচক প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান। ভ্যাকসিন গ্রহণ করা করোনাকালে খুবই জরুরি ও স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, টিকা নেয়ার পর ভালো আছি। করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। এখন ভ্যাকসিন গ্রহণ করে জয় করলাম।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান টিকা নেয়ার পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, করোনার টিকা নিয়েছি আধা ঘণ্টা হয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত কেমন লাগছে বুঝতে পারছি না। কোনো কিছু অনুভব করছি না, পরে হয়তো বুঝতে পারবো। পরে মন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন আমাকে মন্ত্রিসভায়ও কবিতা পড়তে হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা জিজ্ঞেস করেন কবিতা আছে কিনা। এটা আমার স্বভাবজাত প্রবণতা। টিকা নেয়ার প্রতিক্রিয়ায় আপনাদের দুই লাইন কবিতা শোনাই। ‘যদি বেঁচে যাও করোনার কালে, যদি কেটে যায় মৃত্যুর ভয়। জেনো বিজ্ঞান লড়ে গেছে সদা, নেই ভয়, হবে মানুষের জয়।’
টিকা নেয়ার আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে উপস্থিত হয়ে সারা দেশে সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, সিভিল সার্জনদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি বেলা সোয়া ১১টার দিকে শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যান।
টিকাদান কেন্দ্রে নিবন্ধন কবে, সিদ্ধান্ত হয়নি: প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক দূরত্ব পেরিয়ে এসে কারো যেনো টিকা ছাড়া ফিরতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে কীভাবে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে, কেন্দ্রে কেন্দ্রে নিবন্ধনের সুযোগ কীভাবে তৈরি করা যাবে, সে বিষয়ে এখনো কর্মকৌশল ঠিক করতে পারেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষকেও টিকার আওতায় আনার বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন তারা। সেজন্য স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তারাই (গ্রামাঞ্চলের মানুষ) দেশের ৭০ শতাংশ। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা এ ব্যাপারে সহায়তা করবেন। ডিসির নেতৃত্বে সিভিল সার্জন, পুলিশের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করবেন যেন এসব মানুষ নিবন্ধন করতে পারেন। নিবন্ধন করবেন এবং টিকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেবেন। এ ধরনের ব্যবস্থা আমরা করেছি এবং নির্দেশনাও দেয়া হয়ে গেছে।
শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটে টিকা নেয়ার পর স্বাস্থ্য অধিপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার কাছে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জানতে চান। উত্তরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা তারা পেয়েছেন। তবে নিবন্ধনের আগে টিকা দিলে কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে, সেজন্য স্বাস্থ্য বিভাগ নিবন্ধন করেই টিকা দিতে চায়। যদি রেজিস্ট্রেশন ছাড়া টিকা দেয়া হয় তাহলে যিনি টিকা নেবেন তার জন্যও সমস্যা হবে। এছাড়া আমরা যখন টিকা দেবো, সেক্ষেত্রে কতো ডোজ টিকা লাগবে, কারা আসবে, লজিস্টিকস সাপ্লাই-এসব একটা বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা। তারপরও যারা অনেক দূর থেকে এসেছেন, আরেকদিন আসা কঠিন হবে, তাদের জন্য হয়তো আমরা স্পটে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতে পারি। যারা টিকা নিতে আসবেন তারা যেন ফেরত না যান, সেজন্য আমাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যে যাদের দিতেই হবে (টিকা)। ডা. ফ্লোরা বলেন, নিবন্ধন করলে টিকা এবং টিকা নেয়ার স্থান নির্ধারিত থাকে। এটা টিকাগ্রহীতার জন্যও সুবিধা। এছাড়া টিকা দেয়া এবং পরবর্তী ফলোআপ করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরও সুবিধা হবে।