ফের সরগরম হচ্ছে রাজনীতি। করানোয় গত প্রায় এক বছর রাজনীতির মাঠ বলতে গেলে ফাঁকাই ছিল। দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচির বাইরে রাজনৈতিক দলগুলো খুব একটা সভা-সমাবেশমুখী ছিল না। অনেক কর্মসূচি পালিত হয়েছে অনলাইনে। এখন করোনাভীতি অনেকটাই কমে এসেছে। গতিও ফিরতে শুরু করেছে রাজনীতিতে।
আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বছর পূর্ণ করেছে। চলছে তৃতীয় বছর। বিরোধী শক্তিগুলো ‘বিতর্কিত’ একাদশ নির্বাচনোত্তর এক বছর এক ধরনের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার মধ্য দিয়ে পার করেছে। দ্বিতীয় বছর কেটেছে করোনায়, ঘরবন্দী অবস্থায়। তৃতীয় বছরে এসে ফের সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চলছে। ‘বর্তমান সরকারের অধীনে আর সংসদ নির্বাচন নয়’- এমন দাবিকে বাস্তবে রূপ দিতে নানা কৌশল আঁটা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে আন্দোলনের নতুন নতুন প্লাটফর্ম।
সরকারি দলের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি ‘সরকার পতনের মৌখিক হুঁশিয়ারি’ দিলেও কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে দলটি ধীরে চলো নীতিতেই এগুচ্ছে। দলটি নীতিগতভাবে অন্তত দুটি বিষয়ে এখন একমত, প্রথমত, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন ‘কস্মিনকালেও’ সম্ভব নয় এবং দ্বিতীয়ত, সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েও কোনো ‘ফায়দা’ হবে না। এমন অবস্থানে থেকে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ ইস্যুতেই দলটি পুরো মনোযোগ দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের নানামুখী কলা কৌশল চালানোর পাশাপাশি মাঠের রাজনীতিতেও সরব হতে চায় দলটি।
সরকারের বিরুদ্ধে ভোট ‘কারচুপির’ অভিযোগ এনে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে গতকালই ছয় বিভাগীয় শহরে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে হবে প্রথম সমাবেশ। এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে, ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনায়, ১ মার্চ রাজশাহীতে, ৩ মার্চ ঢাকা উত্তরে এবং ৪ মার্চ ঢাকা দক্ষিণে সমাবেশ হবে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরওয়ার এই কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবার নয়। সেই কথাগুলো আমরা জনগণের কাছে বলব। আমরা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট চাইব, জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোকÑ এটি আমাদের বড় দাবি।’
বিএনপির সদ্য ঘোষিত এই কর্মসূচির প্রতিক্রিয়ায় আওয়মী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘যেকোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে আওয়ামী লীগ স্বাগত জানায়। কিন্তু সমাবেশের নামে সহিংসতা সৃষ্টি করলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শক্তহাতে তা দমন করা হবে।’
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি চলতি বছরজুড়েই নীরবচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনে দলীয় যেসব কর্মসূচি রয়েছে, সেসব কর্মসূচিতেও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি তুলে ধরা হবে। রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসূচির ধরনেও পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছে দলটি।
সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা আলাপকালে বেশ জোর দিয়েই শিগগিরই সরকার পতন আন্দোলনের সূচনা হবে বলে জানান। এ সময় তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের নানা রেফারেন্স তুলে ধরেন।
বিএনপির বাইরেও সরকারবিরোধী আন্দোলনের নতুন নতুন প্লাটফর্ম বা মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহীমের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি দলের নেতারা নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে রয়েছেন। ২০২১ সালেই সরকারের পতন হবে, এমন হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন নেতাদের কেউ কেউ।
‘চলতি বছরেই সরকারের পতন হবে’, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ইতোমধ্যে একাধিকবার এ ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘যে কোনো মুহূর্তে সরকারের পতন ঘটবে।’
ইসলামিক দলগুলোও ধীরে ধীরে সোচ্চার হচ্ছে। তারা দলীয় ও ইস্যুভিত্তিকি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারের ‘দুর্নীতি ও অপশাসনের’ বিষয়গুলো সামনে আনার চেষ্টা করছে। আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারিও দিচ্ছে।
সরকারের গ্রিপে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টিও একটু খোলস বদলানোর চেষ্টা করছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে সন্ত্রাস আর হত্যাকাণ্ডের নির্বাচন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ স্বস্তিতে নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে জনগণ স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী এরকম স্বৈরতান্ত্রিক নির্বাচন প্রত্যাশা করে না। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও হত্যাকাণ্ডের নির্বাচন দেশবাসী চায় না।’
রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোও সোচ্চার হচ্ছে। ছাত্র-অধিকার আদায় ও জাতীয় নানা ইস্যুতে তারা ক্যাম্পাসভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত আলজাজিরার একটি তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে কথা বলছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। ইতোমধ্যে সরকারের কাছে ওই প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা চেয়েছে বিএনপি।
আলজাজিরার বাংলাদেশ সম্পর্কিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিশ্বের সামনে রাষ্ট্রের মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণœ হয়েছে মন্তব্য করে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, ‘প্রতিবেদনের প্রতিটি বিষয়ে সরকারকে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে হবে। আমরা কোনো অবস্থাতেই প্রজাতন্ত্রকে বিপদগ্রস্ত ও নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিতে পারি না।’