মিয়ানমারে স্বাধীনতার নায়ক অং সানের কন্যা অং সান সুচি। যখন তার পিতাকে হত্যা করা হয়, তখন সুচির বয়স মাত্র দু’বছর। কৈশোরের বড় সময় বিদেশে কাটিয়েছেন সুচি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বৃটিশ শিক্ষাবিদ মাইকেল অ্যারিসের সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়। এক পর্যায়ে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের রয়েছে দুটি ছেলে। তারা বসতি গড়েছেন বৃটেনের অক্সফোর্ডে। ১৯৯৮ সালে তখনকার রাজধানী ইয়াঙ্গুনে ফেরেন সুচি তার অসুস্থ মায়ের দেখাশোনার জন্য।
১৯৬২ সালে অভ্যুত্থানের সময় থেকে মিয়ানমার শাসন করছিল সেনাবাহিনী। এর বিরুদ্ধে সেখানে প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল তখনও। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সেই প্রতিবাদে জড়িয়ে পড়েন সুচিও। সুচি ছিলেন চমৎকার বক্তা। ফলে আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার জন্য তাকে সামনের সারিতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু নেতাকর্মীদের হত্যা ও জেল দেয়ার কারণে এই বিক্ষোভ শুরুতেই হোঁচট খায়। এর পরপরই অং সান সুচিকে লেকের পাশে তার বাসভবনে গৃহবন্দি করা হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি সেই বাড়িতেই অবরুদ্ধ ছিলেন। তবে স্বল্প সময়ের জন্য তাকে এই গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল।
অং সান সুচি দেশে গণতন্ত্রের জন্য প্রচারণায় নেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেনাবাহিনী তাকে দেশ ছাড়ার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। কারণ, তার ভয় ছিল, দেশ ছেড়ে গেলে তাকে আর হয়তো দেশে ফিরতে দেয়া হবে না। গণতন্ত্রের পক্ষে আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে সুচিকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়। তার পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন তার বড়ছেলে আলেকজান্দার।
২০১১ সালের আগস্টে তখনকার প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত হয় সুচির। উল্লেখ্য, থেইন সেইনও সাবেক একজন জেনারেল। তিনিও বেসামরিক ঘরানার প্রশাসনের প্রধান ছিলেন। তার সঙ্গে সুচির ওই সাক্ষাতকে গণতন্ত্রের প্রতি আশা জাগানিয়া হিসেবে দেখা হয়। এরপর দর কষাকষি চলতে থাকে। ২০১৫ সালে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটনোর মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরেন অং সান সুচি। এতে মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা খর্ব হয়। সুচি তার পশ্চিমা মিত্রদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুর্দশার সমাধান করবেন।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন এ জন্য।
২০১৭ সালের আগস্টে কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু পরিবর্তন সুপারিশ করা হয়। একদিন পরেই রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিরা রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। সেনাবাহিনী এর জবাব দেয় নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে। তারা গণহত্যা ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। গণধর্ষণ করে যুবতী, নারীদের। এ নৃশংসতাকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জাতিনিধন বলে আখ্যায়িত করেছে। এই সঙ্কট নিয়ে মিথ্যাতথ্যের ‘আইনবার্গ’ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ‘সন্ত্রাসী’দের দায়ী করেন সুচি। এখানে উল্লেখ্য, সন্ত্রাসী বলতে সুচি রোহিঙ্গাদের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুখে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি। এ ছাড়া সেনাবাহিনী রাখাইনে যা করেছে তা আইনের অধীনে করেছে বলে তিনি তাদের সনদ দিয়ে দেন। রাখাইন যখন জ্বলছিল, সুচি তখন কুম্ভকর্ণ। তার যখন ঘুম ভাঙল তখন ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর। এ সময়ে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। দৃশ্যত দলে দলে রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় তিনি বিস্মিত হয়েছেন এমন একখানা ভাব ফুটিয়ে তুললেন। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে বললেন, তারা কেন দেশ ছেড়ে গেছে আমাদেরকে তা জানতে হবে।
এক পর্যায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মামলা করে আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া। সেখানে সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গান সুচি। তবে তিনি যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে বলে স্বীকার করেন। তবে গণহত্যার বিষয় বেমালুম এড়িয়ে যান।
২০২০ সালে পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ক্রেডিবল ইলেকশন্স পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এখনও অং সান সুচির প্রতি আস্থা রয়েছে মিয়ানমারের শতকরা ৭৯ ভাগ মানুষের। আগের বছর এই হার ছিল শতকরা ৭০ ভাগ। নভেম্বরে দেশে পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়। সরকারি ফলে দেখা যায়, তার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্রেসি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ফলে দেশে পরবর্তী সরকার গঠন করতে চলেছেন সুচি। তবে এনএলডি জানিয়ে দেয়, তারা জাতীয় ঐকমতের সরকার গঠন করবে। কিন্তু নির্বাচনের ফল নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে সেনাবাহিনী। তারা দাবি করতে থাকে নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে। এ জন্য ‘অ্যাকশন’ নিতে হবে বলে গত সপ্তাহে হুঁশিয়ারি দেন সেনাপ্রধান হ্লাইং। তারই পরিণতি ঘটালেন তিনি ১লা ফেব্রুয়ারি ভোরে। সবাই যখন শীতের ভোরে কম্বল বা লেপের উষ্ণতায় আড়ষ্ট তখন আরেক বেদনাদায়ক অধ্যায় রচনা করলো সেনাবাহিনী। তারা অং সান সুচিকে আটক করলো। আবার শুরু হলো সুচির বন্দিজীবন।