কয়েক দশক পরে ২০১৫ সালে মিয়ানমার গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় ফিরলেও ক্ষমতার নেপথ্যে থেকে যায় দেশটির অমিত শক্তিধর সেনাবাহিনী। বেসামরিক নেত্রী, কমপক্ষে ১৫ বছর গৃহবন্দী থাকা ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নেত্রী অং সান সুচি ক্ষমতায় ফিরলেও তার মেরুদ- সোজা রাখতে পারেননি। এমনটা অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। তিনি যে বিশ্বজোড়া শান্তির প্রতীক, গণতন্ত্রের আইকনে পরিণত হয়েছিলেন, তা তলে তলে ধ্বংস করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। শেষ পর্যন্ত তার আন্তর্জাতিক মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীই তাকে আবার ফেরত পাঠিয়েছে সেই বন্দিদশায়। মিয়ানমারের ঝানু ‘রাজনৈতিক’ সেনাবাহিনীর রাজনীতি হয়তো বুঝে উঠতে পারেননি সুচি। তাই তাদের পক্ষ নিয়ে তিনি রোহিঙ্গা নির্যাতনের সময় ছিলেন চুপ করে। এমনকি সেনাবাহিনীর জয়গান গেয়েছেন তিনি।
সারাবিশ্বকে যখন কাঁদিয়েছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিনিধন’ তখন তার কণ্ঠ রুদ্ধ। এতে বিস্মিত হয়েছে বিশ্ব। আবার যখন তাকে গ্রেপ্তার করেছে তারই সেই সেনাবাহিনী তখন সেই বিশ্বই বিস্ময়ের চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে। কিন্তু তিনি কি এখন আর সেই আগের অনুকম্পা পাবেন! সঙ্গত কারণেই এসব প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। মিয়ানমারে সর্বশেষ যে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে সেখানেই সেনাবাহিনী তাদের রাজনীতির ঘুঁটি চেলেছে। সরকারে তাদের অবস্থানকে শক্তভাবে ধরে রাখতে পার্লামেন্টে শতকরা ২৫ ভাগ কোটা সংরক্ষিত রেখেছে। এর ফলে যে সরকারই
মিয়ানমারে বেসামরিক লেবাসে আসুক না কেন, তাদেরকে আসলে সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল হয়ে থাকতে হবে।
গত নভেম্বরে মিয়ামনারে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্লামেন্টের শতকরা ৮৩ ভাগ আসনে বিজয়ী হয়েছে সুচি নেতৃত্বাধনি এনএলডি। কিন্তু এই ফল মানতে নারাজ সেনাবাহিনী। তারা দাবি করছে, নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। এ জন্য সেনাবাহিনী ‘টেক অ্যাকশন’ বা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয় গত সপ্তাহে। তখন থেকেই মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের গা শিউরে উঠার মতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অং সান সুচি মিয়ানমারের সাবেক এক রাজবন্দি। কয়েক দশকের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দীর্ঘ এক আইকন তিনি। বয়স এখন ৭৫ বছর। বহু বছর গৃহবন্দি থাকার পর তিনি ২০১৫ সালে ক্ষমতায় ফেরেন। বিশ্বজোড়া খ্যাতি পান তিনি। তার কাছ থেকে নতুন কিছু প্রত্যাশা করে বিশ্ববাসী। কিন্তু ২০১৭ সালে রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নৃশংসতার কারণে তার সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি ধুলোয় মিশে যায়। চারদিক থেকে ধিক্কার জানানো হয় তাকে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনবীর সেই নৃশংসতার হাত থেকে জীবন বাঁচালে কমপক্ষে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। অথচ তাদের জন্য মন টলেনি ‘মানবতার নেত্রী’ অং সান সুচির। তিনি সেনাবাহিনীর পক্ষেই সাফাই গেয়ে যান। এমনকি হেগে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে দাঁড়িয়েও তিনি নিজের অর্জিত সম্মানকে বিসর্জন দেন। তবে কি পর্দার আড়ালে তার পিছনে বন্দুক তাক করা ছিল? ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী দেশটির সংবিধানে যে পরিবর্তন আনে তাতে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের স্থায়ী ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের হাতে চলে যায় প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়। যে দল বা যাদের হাতে এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থাকে, আসলে ক্ষমতার মালিকতো তারাই! ফলে এ প্রশ্ন করাই যায়, সুচি বেসামরিক নির্বাচিত নেত্রী হলেও পর্দার আড়ালে ক্ষমতার মালিক ছিল সেনাবাহিনীই। কিন্তু তা এবার নগ্নভাবে সামনে এসেছে। সরাসরি ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে সেনাবাহিনী।