একদিনে প্রায় ৭০ হাজার পরিবারকে আশ্রয় দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছায় মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে এই ঘর উপহার দেয়ার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। শনিবার প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৭০ হাজার পরিবারকে তাদের আশ্রয় বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬৬ হাজার পরিবারকে দেয়া হয়েছে বারান্দা, রান্নাঘর, শৌচাগারসহ দুই কক্ষের ঘর। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় এই মানবিক প্রকল্পের ঘর পেয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় প্রকল্প এলাকায়। যারা আশ্রয় পেয়েছেন তাদের অনেকের স্বপ্নেও ছিল না এমন পাকা বাড়িতে থাকার। তবে এই প্রকল্প ঘিরে বাণিজ্যের অভিযোগও পাওয়া গেছে বিভিন্ন স্থান থেকে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অসাধুদের মাধ্যমে অর্থ নেয়া হয়েছে উপকারভোগীদের কাছ থেকে।
কোথাও কোথাও নেয়া হয়েছে নির্মাণ সামগ্রীর দাম। আবার কোথাও মালামালের ভাড়ার কথা বলে নেয়া হয়েছে অর্থ। এমন বেশকিছু অভিযোগের সরাসরি তথ্য দিয়েছেন উপকারভোগীরা।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে ভূমিহীন ও গৃহহীদের ঘর নির্মাণের জন্য ৩০-৩৫ হাজার টাকা নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ উপজেলায় মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ থেকে ৪৯১টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ১৫০টি ঘরের কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ঘর তৈরিতে শর্ত রয়েছে সেমিপাকা প্রতিটি ঘরে থাকতে হবে দুইটি বেডরুম, ১টি বাথরুম, বারান্দা এবং উপরে উন্নতমানের রঙিন টিন। যার জন্য ঘরপ্রতি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। তবে এসব ঘর বিনামূল্যে দেয়ার কথা থাকলেও এ উপজেলায় ঘটছে ভিন্নতা। জনপ্রতি দিতে হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা করে। অভিযোগ রয়েছে- টাকা দিয়ে ঘর পাওয়ার পরও ইট-বালুসহ অর্ধেক নির্মাণ সামগ্রী কিনতে হচ্ছে নিজেদের। যাতে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে আরো ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
ঘর উপহার পাওয়া উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ১নং ওয়ার্ডের মো. শাবু হাওলাদার জানান, ঘরের জন্য নাম দিতে ইউপি সদস্য মিন্টু হাওলাদারকে ৩৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু ঘরের জন্য সরকার যে নির্মাণ সামগ্রী দিয়েছে তাতে ঘরের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে না এমন কথা বলে আমার কাছ থেকে আরো ১১শ’ ইট এবং ৩০ ব্যাগ সিমেন্ট নেয়া হয়েছে। একই ওয়ার্ডের মো. শাকিল বলেন, ইউপি সদস্য মিন্টু হাওলাদারকে ঘরের জন্য প্রথমে ৩০ হাজার ও ১৫ দিন পর মালামালের ভাড়া বাবদ ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। একই ওয়ার্ডের হাসি বেগম জানান, আমার মা সাফিয়া বেগমের নামে বরাদ্দকৃত ঘরের জন্য ইউপি সদস্য মিন্টু হাওলাদারকে ৩৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়াও একই ওয়ার্ডের শাহিনুর বেগম জানান, ঘর পেতে ঠিকাদার শাওনকে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
চরমোন্তাজ ইউনিয়নের উত্তর চরমোন্তাজ ৬নং ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর ফরাজী বলেন, ঘর পেতে আমাকে ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্যের স্বামী জলিল হাওলাদারের কাছে প্রথমে ২০ হাজার ও পরে মালামালের ভাড়া বাবদ ১৫ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু তারা ঘর নির্মাণের জন্য যে নির্মাণ সামগ্রী দিয়েছে তার পরও আমাকে ২৪ হাজার টাকার নির্মাণ সামগ্রী কিনতে হয়েছে। ইট ২ হাজার, রড ১৩ কেজি, সিমেন্ট ৩০ ব্যাগ নিজের টাকায় কিনেছি। একই অভিযোগ করেন এ ওয়ার্ডের মাহাবুব হাওলাদারও।
চরমোন্তাজ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হালিম খান বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান মো. হানিফ মিয়া আমার মাধ্যমে ৩টা ঘরের নাম দিয়েছেন, প্রতিটি ঘরের জন্য তাকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এমনকি আমার আপন ভাইয়ের জন্য ঘরের নাম দিতে ১২ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এ ব্যাপারে ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মিন্টু হাওলাদার মানবজমিনকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষ এসব অভিযোগ ছড়িয়েছে। এ অভিযোগ সত্য নয়। ৩নং ছোটবাইশদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান হাজী আব্দুল মান্নান মানবজমিনকে জানান, ঘরের জন্য কোনো টাকা নেয়া হয়েছে কিনা তা তার জানা নেই। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। চরমোন্তাজ ইউপি চেয়ারম্যান মো. হানিফ মিয়া মানবজমিনকে জানান, ইউপি সদস্যরা টাকা নিয়ে থাকলে নিয়েছে। আমাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয়নি। কেউ আমার কাছে অভিযোগও করেনি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাশফাকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ঘরের তালিকা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে করা হয়েছে। অনিয়ম হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তবে কেউ যদি টাকা দিয়ে থাকে সে তো আরো বড় অন্যায় করেছে। আগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী মানবজমিনকে জানান, এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ওদিকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে উপজেলায় ১৬৩টি ভূমিহীন পরিবারকে ০২ শতাংশ করে খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে সেখানে একটি সেমিপাকা গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। যার প্রতিটি গৃহ নির্মাণের জন্য সরকারি ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে শেরপুর উপজেলায় প্রায় তিন কোটি টাকার এই কাজের দেখভাল করছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। শেরপুর উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে সুঘাট ও শাহবন্দেগী এই দুই ইউনিয়ন বাদ রেখে বাকি ৮টি ইউনিয়নে এই দুর্যোগ সহনীয় ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।
শেরপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মাকড়কোলা গ্রামের আলাউদ্দিন রনি জানান, আমাদের গ্রামে ভূমিহীনদের জন্য তিনটি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে নিম্নমানের ইট-সিমেন্ট দেয়া হচ্ছে। সেখানে ইটের খোয়ার পরিবর্তে বিল্ডিং ভাঙা পচা রাবিশ আর নিম্নমানের বালু ও কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই কারণে কয়েকটি ঘরের দেয়ালে হস্তান্তরের আগেই ফাটল ধরেছে। প্রকল্পের ১২ নং উপকারভোগী শেরপুর উপজেলার ১নং কুসুম্বী ইউনিয়নের বাগড়া কলোনী গ্রামের মৃত. আবু বক্করের স্ত্রী বাছিরন বেগম। তিনি জানান, ঘরের কাজ ভালো করার জন্য ৫ বস্তা সিমেন্ট আমি নিজে কিনে দিয়েছি। তাছাড়া ঢালাইয়ের কাজে রডসহ প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ দিতে হয়েছে। এই প্রকল্পের ১নং উপকারভোগী একই গ্রামের সেকেন্দার আলীর স্ত্রী গৃহিণী রুবিয়া খাতুন জানান, তিনিও কাজ ভালো করার জন্য দুই বস্তা সিমেন্ট দিয়েছেন। কিন্তু ঘরের কাজ ভালো হয়নি। ঘরের মেঝেসহ অন্যান্য কাজ ভালো হয়নি। দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ছে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হাসান ওয়াদুদ জানান, প্রকল্পের কাজ এখনো চলছে। তাই এ বিষয়ে এখন বক্তব্য দেয়া যাবে না।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোছা. শামছুন্নাহার শিউলী জানান, প্রকল্পের নকশা ও প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজ করা হয়েছে। ঘর নির্মাণে যে টাকা বরাদ্দ রয়েছে তা অপ্রতুল। দুই একটি জায়গায় নিম্নমানের কাজের অভিযোগ পাওয়ায় সেগুলো ঠিক করা হয়েছে। এ বিষয়ে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. লিয়াকত আলী সেখ জানান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে শেরপুর উপজেলায় ১৬৩টি গৃহ নির্মাণ করে ভূমিহীনদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গৃহনির্মাণ কাজে কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। উপকারভোগীদের কাছ থেকে নির্মাণ সামগ্রী নেয়া হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।