করোনায় দারিদ্র্য বেড়েছে

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম-এর জরিপ অনুযায়ী, করোনাকালীন দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে, যা কোভিডের আগের হারের প্রায় দ্বিগুণ। দারিদ্র্যের পাশাপাশি সমাজে বৈষম্যও বেড়েছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। জরিপের এই ফলাফল নিয়ে দেশে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, সানেম-এর জরিপ একটা স্যাম্পল মাত্র। এই জরিপের মাধ্যমে সারা দেশের দারিদ্র্যের অবস্থা বোঝা যাবে, তেমনটি না হলেও দারিদ্র্য বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

উল্লেখ্য, কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে কোভিড-পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে দেশব্যাপী জরিপ পরিচালনা করে সানেম। শনিবার ‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব: সানেম-এর দেশব্যাপী জরিপের ফলাফল’ শীর্ষক ওয়েবিনারে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। সারা দেশব্যাপী জরিপটি ২০২০ সালের ২রা নভেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত হয়। কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে কোভিড-পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও কর্মসংস্থানের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়াই জরিপের মূল উদ্দেশ্য ছিল।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সঙ্গে যৌথভাবে জরিপ হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সানেম-এর জরিপ একটা স্যাম্পল মাত্র। অন্য একটি প্রতিষ্ঠান বলেছে দারিদ্র্য বেড়েছে ৩০ শতাংশ। তবে করোনাভাইরাসের কারণে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কারণ করোনাকালীন অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। প্রবাসীরা বেশ চাপে আছেন। সে হিসেবে সানেম-এর জরিপ ঠিক আছে বলেই মনে হচ্ছে।
সানেম-এর উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বরিশালে ছিল ২৯.৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৩৫.১ শতাংশ, ঢাকায় ৩৮.৪ শতাংশ, খুলনায় ৪১.৮ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৪৬.২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৫৫.৫ শতাংশ, রংপুরে ৫৭.৩ শতাংশ এবং সিলেটে ৩৫ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রভাবে দরিদ্র মানুষের সব ধরনের ব্যয় করার ক্ষমতা কমেছে। তবে আয়ের সিংহভাগ খাদ্য কিনতে ব্যয় করার প্রবণতা দেখা গেছে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় নেমে আসা মানুষ নিজে থেকে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে। তাছাড়া সার্বিক রেমিট্যান্স আয় বাড়লেও জরিপে অংশ নেয়া পরিবারগুলো জানিয়েছে, আগের বছরগুলোর তুলনায় গত বছর বিদেশে থাকা স্বজনরা কম টাকা পাঠিয়েছেন।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালে জিইডি ও সানেম-এর জরিপে এ হার ছিল ২১.৬০ শতাংশ। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩০ শতাংশ। বিবিএসের খানা জরিপে ২০১৬ সালে গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র মানুষ ছিল ২৬.৪০ শতাংশ। ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপে ছিল ২৪.৫০ শতাংশ। সানেম-এর সর্বশেষ জরিপে তা বেড়ে ৪৫.৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮.৯০ শতাংশ। ২০১৮ সালে ছিল ১৬.৩০ শতাংশ। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে বেড়ে হয়েছে ৩৫.৪০ শতাংশ।
জরিপের তথ্য তুলে ধরে সেলিম রায়হান জানান, অতি দারিদ্র্যের হার বেড়ে সাড়ে ২৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে জিইডি-সানেম-এর জরিপে যা ছিল ৯.৪০ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালে ১১.২০ শতাংশ ছিল, যা বেড়ে হয়েছে ৩৩.২০ শতাংশ। শহরাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ৬.১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯ শতাংশ। তিনি জানান, ২০১৮ এবং ২০২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু শিক্ষা ব্যয় কমেছে। অতি দরিদ্র পরিবারে এ হার কমেছে সবচেয়ে বেশি ৫৮ শতাংশ। অন্যদিকে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, দেশে ২০২০ সালে ২০১৮ সালের তুলনায় মাথাপিছু গড় শিক্ষা ব্যয় কমেছে। অতি দরিদ্র পরিবারের জন্য এ হার কমেছে সবচেয়ে বেশি (৫৮ শতাংশ)। অন্যদিকে গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে, মধ্যম দরিদ্র (৯৭ শতাংশ) এবং অ-দরিদ্র (১০৪ শতাংশ) পরিবারের জন্য এটি সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয় সাধারণত ভোগ দিয়ে। কিন্তু দারিদ্র্য যে বহুমুখী ধারণা, যেমন শিক্ষা ও চিকিৎসায়ও এর প্রভাব দেখা যায়, সানেম-এর জরিপ এই প্রথম এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিচ্ছে। এ জরিপের তথ্য বলছে, দারিদ্র্যের ভৌগোলিক আওতা ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামে যে হারে দারিদ্র্য বেড়েছে, শহরেও একই হারে বেড়েছে। আবার যেখানে আগে দারিদ্র্য কম ছিল, সেখানেও ব্যাপক বেড়েছে, যেখানে বেশি ছিল সেখানেও ব্যাপক বেড়েছে। তিনি বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপে দারিদ্র্য যেভাবে পরিমাপ করা হয়, খাদ্য ও অন্যান্য ভোগের তথ্য যেভাবে আলাদা পদ্ধতিতে সারা বছর ধরে সংগ্রহ করা হয়, সানেম-এর জরিপে সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়নি। সে জন্য তিনি মনে করেন, এই দুই জরিপের তথ্য তুলনা করা ঠিক নয়।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে দারিদ্র্যের ওপর প্রভাব পড়ছে এবং করোনার আগের দারিদ্র্যবিষয়ক অর্জনগুলো কোভিড-১৯ এর প্রভাবে উল্টে যাবে, সেই ধারণাটি আরো জোরালো হয়েছে এ সমীক্ষার মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ (বিআইডিএস)-এর গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, সানেম-এর জরিপের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি না। তবে এই জরিপ দিয়ে সারা দেশের দারিদ্র্যের অবস্থা বোঝা যাবে, তেমনটি নয়। এ ছাড়া সারা দেশে কতো শতাংশ দারিদ্র্য আর কতো শতাংশ ধনী, সেটা স্পষ্ট নয়। পত্র-পত্রিকায় যা এসেছে তার আলোকেই বলছি। তবে সার্বিকভাবেই কারোনাকালে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *